আলোকিত কক্সবাজার ডেক্স॥
যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধা তথা জিএসপির পুনর্বহাল সুদূর পরাহতই রয়ে গেছে। রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী শ্রমিক সংগঠন করার বিধান, শ্রমিকদের সংগঠন ও সমাবেশ করার অধিকার প্রশ্নে আটকে গেল জিএসপি সুবিধা। যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তরের সহকারি প্রতিনিধি মাইকেল জে ডিলেনি সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফর করে এমন ইঙ্গিতই দিয়ে গেলেন। এদিকে বাণিজ্য মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ জিএসপি পুনর্বহালের জন্য ১৬টি পূর্ব শর্ত পূরণ হয়েছে দাবি করে বলেছেন, বাংলাদেশ সব শর্ত পূরণ করেছে। নতুন করে কিছু করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশ জিএসপি না পেলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা কাঠামোগত চুক্তি টিকফা অর্থবহ হবে না।
মার্কিন বাণিজ্য দপ্তরের সহকারি প্রতিনিধি মাইকেল ডিলেনির নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল সপ্তাহব্যাপী বাংলাদেশ সফরের শেষ দিনে বুধবার সকালে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদের সঙ্গে সাক্ষাত্ করেন। পরে বাণিজ্যমন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে জিএসপি (শুল্ক ও কোটামুক্ত রপ্তানি সুবিধা) না পাওয়া যায় তাহলে টিকফা (বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি) যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তা অর্থবহ হবে না। তিনি বলেন, আমরা জিএসপি পুনর্বহালের জন্য সব শর্ত পূরণ করেছি। এর বাইরে আর কিছু করা সম্ভব নয়। এখন তাদের উপর নির্ভর করছে তারা জিএসপি দেবে কি দেবে না।
মন্ত্রী সাংবাদিকদের আরো বলেন, জিএসপি ফিরে পাওয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্র যে ১৬টি শর্ত দিয়েছিল তার সবগুলোই পূরণ করেছি। তারা বলেছে, আমাদের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। তারা চট্টগ্রাম ইপিজেড (রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা) পরিদর্শন করেছে। সেখানে শ্রমিকদের সঙ্গে তারা সরাসরি কথা বলেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আমি তাদের পরিষ্কার বলে দিয়েছি, আমাদের পক্ষ থেকে যা করা হয়েছে, এর বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। তারা জানিয়েছে, আগামী নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টিকফা বৈঠকে বিষয়টি আলোচনা ?করা হবে। এ সময় জিএসপি ফিরে পেতে নতুন কোন শর্ত দেয়া হয়নি বলেও জানান তিনি।
এদিকে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, মন্ত্রী জিএসপি ফেরত পাওয়ার ক্ষেত্রে ১৬টি শর্ত পূরণের বিষয় ও বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতের শ্রম অধিকার রক্ষায় অগ্রগতির বিষয়টি উল্লেখ করেন। তিনি শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, নতুন শ্রম আইন ও এর বিধি প্রণয়ন, ইপিজেড এলাকায় শ্রমিকদের জন্য ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন করা, অন্যান্য এলাকার শ্রমিকদের যথাযথ আবেদনের ভিত্তিতে ট্রেড ইউনিয়নের অনুমোদন দেয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন।
মন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের রপ্তানিমুখী ৩ হাজার ৬৮৫টি গার্মেন্টস কারখানার মধ্যে এ্যাকর্ড ও এ্যালায়েন্স এবং সরকারের উদ্যোগে ৩ হাজার ৪০৭ টি কারাখানা পরিদর্শন করা হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৩৪ টি কারখানায় সমস্যা ছিল। সেগুলো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কারখানাগুলোতে বৈদ্যুতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ফায়ার সেফটি ডোর শুল্কমুক্ত আমদানির সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। এখন নিরাপদ পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করছেন। এখন আর এ্যাকর্ড, এ্যালায়েন্সের কারখানা পরিদর্শনের প্রয়োজন নেই।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতকে জিএসপি সুবিধা দিতো না। প্লাস্টিক, টোবাকো, সিরামিক, টেবিল ওয়্যারেরমত কিছু আইটেমের উপর জিএসপি সুবিধা পেতো বাংলাদেশ। যার পরিমাণ বছরে ২৩ মিলিয়ন ডলার। এটি সেখানে মোট রপ্তানির এক শতাংশেরও কম। এতে বাংলাদেশের তেমন আর্থিক ক্ষতি না হলেও এর মাধ্যমে ইমেজ সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
মার্কিন প্রতিনিধি গতকাল বিকেলে ধানমন্ডির এমকে সেন্টারে এক বক্তৃতায় জিএসপি ইস্যুতে মার্কিন সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। মাইকেল ডিলেনি বলেন, সরকারের দাবি অনুযায়ী জিএসপি পুনর্বহালের জন্য ইতিপূর্বে দেয়া ১৬টি শর্ত পূরণ হয়েছে। কিন্তু আমাদের মূল্যায়ন হল, এক্ষেত্রে আরো কিছু করণীয় রয়েছে। জিএসপি পুনর্বহালের জন্য আরো পথ পাড়ি দিতে হবে। এখন জিএসপি ফিরে পাওয়া পুরোপুরি বাংলাদেশের উপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ যত দ্রুত আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখবে, তত দ্রুত জিএসপি ফিরে পাবে। পোশাক কারখানার নিরাপত্তা, শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিক স্বার্থ এখানে মূল বিষয়। ইপিজেডের ভেতরে বাইরে শ্রমিক ইউনিয়ন থাকতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট আইন পরিবর্তন ও সংস্কার জরুরি।
তিনি বলেন, ইপিজেডের ভেতরে শ্রমিকদের স্বাধীনভাবে সংঘটিত হওয়ার সুযোগ থাকতে হবে। এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান পূরণ করতে হবে। শ্রমিক সংগঠনগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে। শ্রমিকদের যেকোন সমস্যা বা ঘটনা স্বচ্ছভাবে প্রকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
মার্কিন প্রতিনিধি বলেন, গার্মেন্টস খাতে নিয়োজিত ৪০ লাখ শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়ন, নিরাপত্তা, ভালো কর্মপরিবেশ, আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত প্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। জিএসপি অ্যাকশন প্ল্যান অনুযায়ী সব শর্ত পুরোপুরি পূরণ করলে মার্কিন বিনিয়োগকারীরা এদেশে আসতে আরো উত্সাহিত হবে। এর ফলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে।
তিনি বলেন, জিএসপির বাইরে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো বাড়ানো যায়। টিকফা ফোরামে দু’দেশের বাণিজ্য ইস্যুতে আলোচনা করা যায়। তিনি বলেন, জিএসপি ইস্যুটি কখনোই রাজনৈতিক নয়। জিএসপি স্থগিতের সিদ্ধান্ত ছিল তথ্য ভিত্তিক।
রানা প্লাজা ট্র্যাজেডির পর প্রেসিডেন্ট ওবামা ২০১৩ সালের জুন মাসে জিএসপি স্থগিত করেন।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট অনুষ্ঠানে বলেন, জিএসপি এ্যাকশন প্লান অনুযায়ী আরো কিছু করার আছে ও অনেক দূর যেতে হবে। বাংলাদেশের শ্রমিকদের উন্নয়নে যুক্তরাষ্ট্র ১২ মিলিয়ন ডলার সহযোগিতা করেছে। নিরাপত্তার জন্য ভবিষ্যতে ২২ মিলিয়ন ডলার দেয়া হবে।
মন্তব্য করুন