
সাম্প্রতিক কোরবানির পশু পালনে বাংলাদেশে একটি অসুস্থ নীরব প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায়। আর তা হচ্ছে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও মারাত্মক ওষুধ প্রয়োগ করে গরু মোটাতাজাকরণ। গরু মোটাতাজা করার জন্য একটি স্বাস্থ্যসম্মত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি রয়েছে। এ পদ্ধতিতে গরু মোটাতাজা করতে চার থেকে পাঁচ মাস সময় লাগে। এতে কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকে না। কিন্তু অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় মানুষের জন্য ক্ষতিকর ওষুধ ব্যবহারের মাধ্যমে গরু মোটাতাজা করে। মাত্রাতিরিক্ত স্টেরয়েড দিয়ে অল্প সময়ে মোটাতাজা করতে গিয়ে একদিকে যেমন প্রাণীর স্বাস্থ্য ঝুঁঁকিপূর্ণ করে তোলা হয়, অন্যদিকে এসব গরুর গোশত মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। এসব গোশত দীর্ঘমেয়াদে খেলে মানুষ কিডনি, লিভার ও বন্ধ্যত্বসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ পঙ্গুত্ববরণও করতে পারে। এছাড়া স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ মানব শরীরে বেশিমাত্রায় জমা হলে মানুষের বিপাক ক্রিয়ায়ও প্রভাব পড়ে। মানুষও অস্বাভাবিক হারে মোটা হতে থাকে। বিশেষ করে শিশু ও গর্ভবতী নারীর জীবনে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। তাই কোরবানির জন্য মোটাতাজা গরু ক্রয় নিয়ে সাধারণ মানুষ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। এভাবে বিষাক্ত মেডিসিন খাইয়ে গরু মোটাতাজা করে বিক্রি করা ইসলামের দৃষ্টিতে জায়েজ নয়। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন কীভাবে পরিচালনা করবে তার সুন্দর দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। মানুষের অর্থনৈতিক কর্মতৎপরতার অংশ হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য করা ইসলামে ইবাদত হিসেবে পরিগণিত। হালাল জীবিকা উপার্জনের জন্য রাসুলে করিম (সা.) সহ অনেক নবী-রাসুল এবং সাহাবায়ে কেরাম ব্যবসা-বাণিজ্য করেছেন। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন জায়গায় জীবিকা উপার্জনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘সালাত সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ (রিজিক) সন্ধান করো। আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো, যাতে তোমরা সফলতা লাভ করো।’ (সূরা জুুমা : ১০)। আল্লাহ তায়ালা অন্য আয়াতে হালাল ও উত্তম আহারের নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা আমার দেয়া হালাল ও উত্তম রিজিক আহার করো এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করো যাতে তোমরা সফলতা অর্জন করো।’ (সূরা বাকারা : ১৭২)। অন্যত্র আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘হে মোমিনরা! তোমরা একে অন্যের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না; তবে তোমাদের পারস্পরিক সম্মতিক্রমে ব্যবসা করা বৈধ।’ (সূরা নিসা : ২৯)। এ আয়াতের তাৎপর্য হলো, মিথ্যা বলে, ধোঁকা দিয়ে, প্রতারণা করে, চুরি করে এবং অবৈধ পন্থায় অন্যের সম্পদ ভোগ করা কিছুতেই বৈধ হবে না। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর সব উম্মতকে জীবিকা উপার্জনের ক্ষেত্রে হালাল ব্যবসার নীতি গ্রহণ এবং হারাম পন্থা পরিহারের তাগিদ দিয়েছেন। হারাম খাদ্যে পরিপুষ্ট ব্যক্তির দোয়া কবুল হয় না এবং সে কখনও জান্নাতে যাবে না। যেমন হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ওই দেহ জান্নাতে যাবে না, যা হারাম দ্বারা পরিপুষ্ট হয়েছে।’ (বায়হাকি, মিশকাত : হা/২৭৮৭)।
হালাল বস্তুও হারাম মেশানোর কারণে এবং প্রতারণা যুক্ত হওয়ায় হারামে পরিণত হয়। যেমন- মাছ-গোশত, শাকসবজি, ফলমূলের সঙ্গে বিষাক্ত কেমিক্যাল মেশানো। দুধের সঙ্গে পানি বা পাউডার মেশানো, সাধারণ পানি বোতলজাত করে মিনারেল ওয়াটার বলে চালানো, নিম্নমানের পণ্য উন্নতমানের বলে প্রচার করা, নিচে নিম্নমানের পণ্য রেখে ওপরে উত্তম পণ্য সাজানো, দুগ্ধবতী গাভি বিক্রি করার আগে দুধ আটকানো, গরু মোটাতাজা করার নামে ইউরিয়া সার ও অন্যান্য বিষাক্ত বস্তু খাওয়ানো, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মুরগি বিক্রির আগে তাকে পাথরের টুকরা খাইয়ে ওজন বাড়ানো ইত্যাদি। এগুলোর দ্বারা মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়। এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না এবং কারও ক্ষতি করবে না।’ (আহমাদ, ইবনে মাজাহ : ২৩৪০)। যারা জেনে-শুনে এভাবে মানুষের ক্ষতি করে, সাময়িক লাভবান হলেও তারা হারামখোর। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমাদের ধোঁকা দেয়, সে আমাদের দলভুক্ত নয়। ধোঁকাবাজ ও প্রতারক জাহান্নামি।’ (মুসলিম, মিশকাত : ৩৫২০)। ওই ব্যক্তি কেয়ামতের দিন রাসুলুল্লাহ (সা.) এর শাফায়াত পাবে না। ফলে সে জাহান্নামি হবে। যারা বিষ ও ভেজাল মেশানোর মাধ্যমে মানুষ হত্যা করে, তাদের বিরুদ্ধে আল্লাহ বলেন, ‘যে ব্যক্তি নরহত্যা বা জনপদে ফ্যাসাদ সৃষ্টি ছাড়াই কাউকে হত্যা করল, সে যেন সব মানুষকে হত্যা করল।’ (সূরা মায়েদা : ৫/৩২)। তিনি বলেন, ‘তোমরা পরস্পরকে হত্যা করো না।’ (সূরা নিসা : ৪/২৯)।
তাদের ব্যাপারে আমাদের করণীয় সম্পর্কে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘তোমাদের কেউ কোনো অন্যায় কাজ দেখলে সে যেন তা হাত দিয়ে প্রতিরোধ করে। তা না পারলে মুখের কথা দিয়ে, তাও না পারলে অন্তর দিয়ে ঘৃণা করে। আর সেটা (শেষেরটা) হলো দুর্বলতম ঈমান।’ (মুসলিম, মিশকাত : ৫১৩৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘এটাও যে করতে না পারে, তার মধ্যে সরিষাদানা পরিমাণ ঈমান নেই।’ (মুসলিম, মেশকাত : ১৫৭)। তাই প্রশাসনের কর্তব্য, এদের ধরে নিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া। সমাজের নেতৃস্থানীয় এবং সচেতন ব্যক্তিদের উচিত, মুখের ভাষা ও কলম দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে তোলা। আর নিরীহ মানুষের কর্তব্য হলো, এসব গর্হিত কাজ মনেপ্রাণে ঘৃণা করা। অন্য সবকিছুর চেয়ে খাদ্যে ভেজাল দেয়া সবচেয়ে মারাত্মক অপরাধ। কেননা খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচে না। যারা এসবে বিষ দেয় ও ভেজাল মেশায়, তাদের ভাবা উচিত যে, দুনিয়ায় মানুষকে ফাঁকি দেয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেয়া যাবে না। ‘মানুষের চোখের চাহনি ও অন্তরের গোপন কথা তিনি জানেন।’ (সূরা মোমিন : ৪০/১৯)। ‘তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তিনি সর্বদা তোমাদের সঙ্গে আছেন এবং তোমরা যা কিছু করো, আল্লাহ সবই দেখেন।’ (সূরা হাদিদ : ৫৭/৪)।
মন্তব্য করুন