মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৩:০৫ অপরাহ্ন

জিলহজের প্রথম দশকের আমল

জিলহজের প্রথম দশকের আমল

অনলাইন বিজ্ঞাপন

মাওলানা আহমাদ উল্লাহ

মিসরের বিখ্যাত ডেন্টিস্ট ও সার্জন শায়খ আব্বাস কারারাহ-এর হজ সার্টিফিকেট, ১৯৩০। তিনি মক্কায় অন্যতম প্রথম হিসেবে দাঁতের চিকিৎসা শুরু করেন
রমজানের পর দীর্ঘমেয়াদি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদতের মৌসুম হলো জিলহজের প্রথম ১০ দিন। বছরের যে কোনো দিনের চেয়ে এ দিনগুলো শ্রেষ্ঠ এবং আল্লাহর কাছে প্রিয়। মুসনাদে বাজজার ও ইবনে হিব্বানে সাহাবি জাবের (রা.) থেকে সহিহ সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, দুনিয়ার শ্রেষ্ঠতম দিনগুলো হলো এই দশক। অর্থাৎ জিলহজের প্রথম দশক। স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা এ মাসের প্রথম ১০টি রাতের শপথ করেছেন, এমনকি ভিন্ন ভিন্নভাবে জোড় ও বেজোড় রাতগুলোর শপথও করেছেন। (সুরাতুল ফাজর : ২-৩)। সুরাতুল হজের ২৮নং আয়াতে বলা হয়েছে, তারা আল্লাহর নামের স্মরণ করেন নির্দিষ্ট দিনগুলোতে। সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, নির্দিষ্ট দিন বলে এখানে জিলহজের প্রথম দশককে বোঝানো হয়েছে। (ইবনে কাছির)।
বোখারির বর্ণনা মতে রাসুল (সা.) বলেছেন, ভালো আমলের জন্য আল্লাহর কাছে এ দিনগুলোর চেয়ে প্রিয় কোনো দিন নেই; সাহাবারা প্রশ্ন করলেন- এমনকি আল্লাহর রাহে জিহাদও এই দিনগুলোর ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়? জবাবে এরশাদ হলো- না, অন্য সময়ে আল্লাহর রাহে জিহাদও এই দশকের ইবাদতের চেয়ে শ্রেষ্ঠ নয়। অবশ্য যে ব্যক্তি জান ও মাল নিয়ে আল্লাহর রাহে জিহাদ করতে বের হয়েছেন এবং তার কোনোটি নিয়েই ফিরতে পারেননি, তার কথা ভিন্ন। বিশ্ববিখ্যাত হাদিসবেত্তা ইবনে হাজার আসকালানি (রহ.) বলেন, জিলহজের প্রথম ১০টি দিনের বিশেষ গুরুত্বের কারণ হলো, এ দিনগুলোতে ইসলামের পাঁচটি রোকনের সমাহার রয়েছে। যেমন ঈমান ও সালাত অন্য দিনগুলোর মতো এ দিনগুলোতেও বিদ্যমান। জাকাত বছরের অন্য যে কোনো সময়ের মতো এ সময়েও প্রদান করা যায়। আরাফার দিনে রোজার নির্দেশনার ফলে ইসলামের আরেকটি রোকন রোজার নজিরও এই দশকে পাওয়া যায়। আর পঞ্চম রোকন বা হজ ও কোরবানির বিধান তো শুধু এ দশকেই পালনযোগ্য।
তাছাড়া এ দশকেই রয়েছে আরাফা ও কোরবানির দিন। আরাফার দিনের দোয়াকে শ্রেষ্ঠ দোয়া বলা হয়েছে। আর কোরবানির দিনও এককভাবে বছরের সেরা দিন বলে আবু দাউদ ও নাসাঈর এক হাদিসে বর্ণিত আছে। সুতরাং মাস হিসেবে রমজান আর দিন হিসেবে এই দশক শ্রেষ্ঠ দিবস বলে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।
একজন মুসলিমকে তাই ইবাদতের এই বৃহত্তর মৌসুমের সদ্ব্যবহার করে অন্য সময়ের আমলের ঘাটতি পূরণ করা উচিত। আক্ষেপের বিষয়, কোরআন ও সুন্নায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব পাওয়া এ ইবাদতের সিজন সম্পর্কে আমাদের সমাজে খুবই স্বল্পসংখ্যক মানুষ ধারণা রাখেন।
প্রথম দশকের ১০টি আমল
(১) সামর্থ্যবান হলে হজ করা। (সূরা আলে ইমরান ৯৭)। (২) কোরবানি করা। (সূরা কাউসার)। (৩) অধিক পরিমাণে আল্লাহর নামের জিকির করা। (সুরা হজ :২৮)। ওই আয়াতে নির্দিষ্ট দিনগুলোতে আল্লাহর নামের জিকির করার কথা বর্ণিত হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ তাফসিরবিদ ওলামায়ে কেরামের অভিমত হলো- ‘নির্দিষ্ট দিনগুলো’ বলতে জিলহজের প্রথম ১০ দিনকে বোঝানো হয়েছে। (৪) অধিক পরিমাণে নেক আমল করা। (বোখারি ও মুসলিম)। (৫) পাপের পথ না মাড়ানো। (প্রাগুক্ত)। (৬) কোরবানি করতে ইচ্ছুক ব্যক্তির এ ১০ দিন নখ, চুল ইত্যাদি কর্তন না করা। (মুসলিম)। (৭) বেশি বেশি তাকবির তাহমিদ ও তাহলিল পাঠ করা, যথা- আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ। (বোখারি)। (৮) আরাফার দিন ফজর থেকে আইয়ামে তাশরিকে (ঈদের দিন ও তার পরে আরও তিন দিন) প্রতি নামাজের পর ওই তাকবির পাঠ করা। (প্রাগুক্ত)। (৯) আরাফার দিনে রোজা রাখা। মুসলিমের এক বর্ণনায় আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন- আরাফার দিনের রোজার ব্যাপারে আমি মনে করি, তার বিনিময়ে আল্লাহ তায়ালা এক বছর আগের ও এক বছর পরের গোনাহ মাফ করে দেবেন। (১০) ঈদের দিনের যাবতীয় সুন্নত পালনে সচেষ্ট হওয়া।
রমজান মাস ইবাদতের মৌসুম, এ বিষয়টি মোটামুটি আমাদের সমাজের সবাই জানেন। কিন্তু জিলহজের প্রথম দশকের গুরুত্ব-তাৎপর্য সম্পর্কে সমাজের বেশিরভাগ লোক জানে না।
কেবলার দিকে থুতু নয়
বেখায়েলে বা না জানার কারণে, অহরহ একটা জঘন্য ভুল করে থাকি আমরা। যে ভুলটির ব্যাপারে শুধু নিষেধাজ্ঞাই আরোপ হয়নি; বরং অপমানকর পরিণতির কথাও বর্ণিত হয়েছে। আর সেটা হলো- কেবলার দিকে থুতু কিংবা শ্লেষ্মা ইত্যাদি নিক্ষেপ করা।
সুনানে আবু দাউদ, ইবনে খুয়াইমা ও ইবনে হিব্বান একযোগে বর্ণনা করেছেন- আল্লাহর রাসুল (সা.) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কেবলার দিকে থুতু নিক্ষেপ করবে, কেয়ামতের দিন তার কপালে সেই থুতুসহ হাজির করা হবে। অপর বর্ণনায় শ্লেষ্মা এবং ডান দিকে নিক্ষেপের কথাও এসেছে। কোনো কোনো বর্ণনায় মসজিদে বা সালাতরত অবস্থায় কেবলার দিকে থুতু নিক্ষেপের ব্যাপারে সতর্ক করা হলেও বেশিরভাগ বর্ণনায় সাধারণভাবেই নিষেধাজ্ঞা বর্ণিত হয়েছে। এ কারণে অধিকাংশ মুহাদ্দিসিনে কেরাম সর্বাবস্থায় কেবলার দিকে থুতু বা কফ নিক্ষেপ করাকে নিষিদ্ধ বলে মন্তব্য করেছেন। তবে নিষেধের মাত্রা কতখানি, সেটা নিয়ে মতপার্থক্য আছে। কেউ মাকরূহ বলেছেন, আবার কেউ হারাম বলেছেন। মাকরূহ তো হাদিস থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়। আর হারাম বলার কারণ হলো, কোনো নিষেধের পাশাপাশি যদি শাস্তির কথা বর্ণিত হয় তবে সেটাকে হারাম বলেছেন অনেকে, সে দৃষ্টিকোণ থেকে হারাম বলা হয়েছে। মোট কথা বিষয়টি বাহ্যিকভাবে খুব তুচ্ছ মনে হলেও হাদিসে বর্ণিত শাস্তির বিবেচনায় অনেক বড় বিষয়, যা থেকে বাঁচার জন্য শুধু সচেতনতাই যথেষ্ট।
প্রতিদিন আমরা বহুবার থুতু নিক্ষেপ করি। কিন্তু হয়তো বা লক্ষ করি না যে, আমার থুতু পশ্চিম দিকে নিক্ষেপ হচ্ছে কিনা! আসুন, অতীত ভুলের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করি এবং ভবিষ্যতে এ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন করি। অন্যদের সচেতন করি এবং শিশুদেরও এ ব্যাপারে সঠিক শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করি।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
Desing & Developed BY MONTAKIM