জাবালে রহমত
পাহাড়টির নাম সাওর। এ পাহাড়ের চূড়াতেই ছোট্ট একটি গুহা। শত্রুর ভয়ে এ গুহায়ই আশ্রয় নিয়েছিলেন রাসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.)। কিন্তু শত্রুরা খুঁজতে খুঁজতে গুহার কাছে চলে এলেন। দেখলেন গুহার মুখে মাকড়সার জাল। তাই তারা ভাবলেন গুহার ভেতরে হয়তো কেউ নেই। কারণ, থাকলে মাকড়সার জাল থাকত না। ফলে শত্রুরা ফিরে গেলেন। এ পাহাড় নিয়ে এমনটাই লেখা আছে ইতিহাসের পাতায়। তারই এক ফাঁকে একদিন বের হই এখানকার দর্শনীয় স্থান দেখতে। মিসফালা ব্রিজের কাছ থেকে গাড়িতে ওঠি। দলে আছেন আরও ১০ জন।
শহর থেকে বের হয়ে প্রথমে আসি জাবালে সাওর বা সাওর পাহাড়ে। কাবা শরিফের দুই থেকে তিন মাইল দক্ষিণে এর অবস্থান। মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের সময় এ পাহাড়ের গুহাতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন রাসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.)। এখানে তাঁরা ছিলেন তিনদিন। আমরা থাকি কিছুক্ষণ। সাওর পাহাড় দেখে চলে আসি জাবালে রহমত বা রহমতের পাহাড়ে। এ পাহাড়ের চূড়ায় একটি পিলার আছে। এ পিলারের স্থানটিই হলো আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.) এর সাক্ষাতের স্থান। এছাড়া এ পাহাড়ের পূর্ব পাশে দাঁড়িয়ে রাসুল (সা.) বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছেন। তাঁর এ ভাষণ শুনেছিলেন প্রায় সোয়া লাখ সাহাবি। রাসুল (সা.) যেখানে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন, আমরাও সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম। এখানে দাঁড়িয়ে আশপাশের অন্য পাহাড়গুলো দেখা যায়। পাহাড়টির সামনে বিশাল মাঠ, সে মাঠের চার পাশে দোকানও আছে।
মাঠে উট নিয়ে ঘুরছেন অনেকে। এসব উটের পিঠে ওঠা যায় রিয়ালের বিনিময়ে।
রহমতের পাহাড় থেকে নেমে আসি আরাফার মাঠে। বিশাল এ মাঠ এখন ফাঁকা। এ মাঠ চার পাশে প্রায় ১০ কিলোমিটার জুড়ে। হজের সময় এ মাঠ হাজীদের পদচারণায় মুখর থাকে। এ মাঠ পার করে আসি মুজদালিফা। হজের সময় হাজীরা এখানে অবস্থান করেন। এখানে মসজিদে মাশআরিল হারাম আছে। রাসুল (সা.) আরাফার মাঠ থেকে ফিরে এসে এখানে মাগরিব-এশা একসঙ্গে আদায় করতেন এবং রাতে থাকতেন।
এছাড়া এখান থেকেই জামারাতে বা শয়তানকে মারার জন্য হাজীদের পাথর সংগ্রহ করতে হয়। তারপর রওনা হই মিনার উদ্দেশে। পথে দেখি মসজিদে নামিরাহ। হাজীদের আরাফায় অবস্থানের সময় এ মসজিদে হজের খুতবা দেয়া হয়। এ পথে আরও দেখলাম ওয়াদিয়ে মুহাসসার। ইতিহাসের পাতায় লেখা এটি সেই স্থান, যেখানে কাবাঘর আক্রমণ করতে আসা আবরাহা বাহিনীকে আকাশ থেকে পাখি পাথর মেরে ধ্বংস করেছিল। মিনায় যাওয়ার পথে পাহাড় ঘেঁষে একটি পানির লাইন দেখলাম।এসব দেখতে দেখতে আসি মিনায় তাঁবুর রাজ্যে।
হজের সময় এ তাঁবুতে থাকেন হাজীরা। তাঁবুগুলো খুবই উন্নত। অনেকটা ঘরের মতো। এসির ব্যবস্থাও আছে। এগুলো অগি্ন প্রতিরোধকও। তাঁবুগুলো ভালো করে দেখাতে চালক আমাদের নিয়ে গেলেন ফ্লাইওভারের উপর। সত্যিই উপর থেকে তাঁবুগুলো দেখতে দারুন। এ মিনাতেই আছে মসজিদে খায়েফ।
মিনার পাশে পাহাড়ের উপরে দূর থেকেই আরও একটি স্থান দেখা হলো। এটি সেই স্থান, যেখানে ইবরাহিম (আ.) ইসমাঈল (আ.) কে কোরবানি দিতে চেয়েছিলেন। স্থানটিতে পাথরের একটি স্তম্ভ আছে। তিনটি শয়তান আছে এখানে।
হজের সময় হাজীরা ১০, ১১ ও ১২ জিলহজ তিনটি পাথর মারেন। ওমরায় শয়তানকে পাথর মারার নিয়ম নেই। তবু মনে মনে শয়তানকে ঘৃণা করে সেখান থেকে ফিরলাম। তারপর এলাম জাবালে নূরের কাছে। এর উচ্চতা ৫৬৫ মিটার। আরবিতে জাবাল অর্থ পাহাড়, আর নূর অর্থ আলো। সেজন্য এর নাম জাবালে নূর। এ পাহাড়ের চূড়াতেই রয়েছে হেরাগুহা বা জ্যোতির ঘর। ছোট্ট এ গুহাতেই ধ্যান করেছেন রাসুল (সা.)। এখানেই তিনি লাভ করেন নবুয়ত। কোরআন শরিফও নাজিল হয়েছে এ গুহাতেই।
বিবি খাদিজা (রা.) রাসুল (সা.) এর জন্য প্রতিদিন দুইবেলা খাবার নিয়ে যেতেন এ গুহায়। দেখলাম অনেকেই চূড়ায় উঠছেন। দলে বয়স্করা থাকায় সেদিন আর চূড়ায় ওঠা হয়নি। পরে একদিন উঠেছিলাম। পাহাড়টির অবস্থান মক্কার পূর্ব দিকে কাবা শরিফের ৫ থেকে ৬ কিলোমিটার দূরে।
আলোর পাহাড় থেকে আমরা আসি জান্নাতুল মুয়াল্লা। এ কবরস্থানে খাদিজা (রা.) এর কবর রয়েছে। আরও অনেক সাহাবির কবরও আছে এখানে।
কাবা শরিফের কিছুটা দূরে এ কবরস্থান। এর পাশেই মসজিদে জিন বা জিনের মসজিদ। এ মসজিদে রাসুল (সা.) এর কাছ থেকে জিনেরা কোরআন শুনেছিলেন।
এ মসজিদ দেখে আসি আবু কোবাইস পাহাড়ে। এটা কাবা শরিফের পূর্ব দিকের পাহাড়টিই। এ পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ইবরাহিম (আ.) হজের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
মন্তব্য করুন