মঙ্গলবার, ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:০৭ পূর্বাহ্ন
এদেশে ৫০ বছরেরও বেশি সময় ধরে ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। কারণ ছাত্র-জনতা আপস মানে না। শিক্ষাদর্শনে আপস বলে কিছু থাকতে পারে না। ১৯৬২ সালের এই দিনে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া শিক্ষানীতিকে প্রত্যাখ্যান করে আহূত হরতালের মধ্যে পুলিশের গুলিতে একাধিক প্রাণহানির প্রতিবাদে এদিনটিকে এদেশের ছাত্রসমাজ শিক্ষা দিবসরূপে পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়, যা পরবর্তী সময়ে দেশের বৃহত্তর জনসমাজের স্বীকৃতি লাভ করে। সেই থেকে ১৭ সেপ্টেম্বর এদেশে শিক্ষা দিবসরূপেই পালিত হচ্ছে।
এবারের শিক্ষা দিবস বিগত বছরগুলোর গতানুগতিকতার ভিড়ে একটু ভিন্ন দ্যোতনা নিয়ে হাজির হয়েছে। এবারের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর ৭.৫ শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপের সিদ্ধান্ত হয়। এর প্রতিবাদে বিভিন্ন ধাপে ওইসব বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবি, বক্তব্য, অনুরোধের ধারাবাহিকতায় প্রায় ৫ দিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী রাজপথে অবস্থান, সরকারি সিদ্ধান্তের সপক্ষে সরকারের বিভিন্ন মহলের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য প্রচারের প্রেক্ষাপটে সরকারের অভ্যন্তরে এ নিয়ে নানামুখী অন্তর্দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ এবং অবশেষে সার্বিক বিবেচনায় ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনান্তে একটি বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির অবসান ইত্যাদি ঘটনাপ্রবাহের প্রেক্ষাপটে এবারের শিক্ষা দিবস অবশ্যই বিশেষ তাৎপর্যবহ।
শিক্ষা দিবসের সার্বিক বিষয় আলোচনার সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর ভ্যাট আরোপের বিষয়টি আলোচনার দাবি রাখে। ( এই ভ্যাট বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ওপর নাকি শিক্ষার্থীদের ওপর আরোপ করা হয়েছিল, তা কিন্তু এই সিদ্ধান্তটি বাতিল বা প্রত্যাহার করার পরও আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। সরকারি মহলের বিভিন্নমুখী বক্তব্য আমাদের আরও বিভ্রান্ত করে দিয়েছে)। এ ধরনের ব্যাপক তরুণ-সংশ্লিষ্ট আন্দোলন মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবেই তার ‘লক্ষ্য’ অর্জন করেছে বলা চলে। জনচলাচলের রাস্তায় অবস্থানের কারণে বেশ জনদুর্ভোগ হয়েছে বটে, তবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করে এদেশে কোনো বড় আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জনের নজির আছে কী? স্বস্তির কথা, সার্বিকভাবে সরকারের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ যথেষ্ট ধৈর্য ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছে, সুযোগ বা পরিস্থিতি থাকা সত্ত্বেও বল প্রয়োগে প্রবৃত্ত হয়নি। কিন্তু তা কি বিষয়টির যৌক্তিকতা নিয়ে সরকারের অভ্যন্তরে বিভ্রান্তি থাকার কারণে? নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোক্তা বা মালিকপক্ষ সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রভাবশালী হওয়ার কারণে? নাকি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরতদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ সরকারি ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে? নাকি দৃশ্যত অরাজনৈতিক একটি দাবির প্রতি অতি অল্প সময়ে বিশেষত ঢাকার নাগরিক সমাজের নৈতিক সমর্থন সম্পর্কে সরকারি নীতিনির্ধারকরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলেন? যে কারণেই হোক, ইস্যুটির একটি শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তিতে আমরা সবাই স্বস্তিবোধ করছি।
ছাত্রছাত্রীরা রাজপথ থেকে শিক্ষাঙ্গনে ফিরেছে বটে, তাতে সত্যি সত্যি কি বৃহত্তর শিক্ষার পরিম-লে স্বস্তির কোনো আবহ সৃষ্টি হয়েছে? শিক্ষা দিবসের আনুষ্ঠানিকতা কি জাতির জন্য কোনো সুস্পষ্ট পথরেখা এঁকে দিতে পেরেছে। এটা বুঝতে হলে শিক্ষা দিবস সৃষ্টির দিনটির দিকে নজর ফেরানো প্রয়োজন। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ সেনাবাহিনী তাদের জাতভাই জেনারেল ইস্কান্দর মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতায় বসায় জেনারেল আইয়ুব খানকে। তিনি ক্ষমতায় এসে তার শাসনকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সচেষ্ট হন। এ উদ্দেশ্যে গৃহীত অন্যান্য পদক্ষেপের সঙ্গে তিনি হাত দেন শিক্ষা ব্যবস্থার ওপর। এ উদ্দেশ্যে ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সাবেক পশ্চিম পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব এস এম শরীফকে প্রধান করে ১১ সদস্যের একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। বিভাগপূর্ব আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে এসএম শরীফ ছিলেন আইয়ুব খানের শিক্ষক। ওই কমিশন চারজন শিক্ষাবিদ এবং সামরিক-বেসামরিক আমলা ও পাকিস্তানের বিশিষ্ট নাগরিকরা সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে কমিশন তার রিপোর্ট পেশ করে। রিপোর্টটির বেশ কয়েকটি সুপারিশ বিশেষত পাকিস্তানের ৫৬ শতাংশ জনসংখ্যা অধ্যুষিত সাবেক পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজকে বিক্ষুব্ধ করলেও এতে পাকিস্তানের শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থার বিভিন্ন দিকের চরিত্র ও দর্শন ফুটে ওঠে অনেকটা পরিষ্কারভাবে।
এর প্রধান প্রধান পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল-
(ক) শিক্ষা এবং শিল্প ক্ষেত্রের বিনিয়োগকে একই দৃষ্টিতে দেখা প্রয়োজন।
(খ) অবৈতনিক সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষার ধারণা অবাস্তব (ইউটোপিয়া) বলে প্রত্যাখ্যান।
(গ) স্বল্পমূল্যে শিক্ষা প্রদানের ধারণাটি ভ্রান্ত।
(ঘ) উর্দুকে সমগ্র পাকিস্তানের ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া প্রয়োজন।
(ঙ) মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার ব্যয়ের তিন-পঞ্চমাংশ শিক্ষার্থীদের বেতন-ভাতা থেকে সঙ্কুলান করা, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমাজের বৃহত্তর অংশগ্রহণ থাকা প্রয়োজন।
(চ) মাধ্যমিক স্তরে আবাসিক শিক্ষাকে উৎসাহ প্রদান।
(ছ) কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব আরোপসহ মাধ্যমিক স্তরে কিছু আবশ্যিক বিষয়ের অন্তর্ভুক্তি।
(জ) উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে শিক্ষা বোর্ডের ওপর ন্যস্তকরণ।
(ঝ) ডিগ্রি ও সম্মান কোর্স দুই বছরের পরিবর্তে তিন বছর মেয়াদিকরণ।
(ঞ) নারী শিক্ষার প্রতি উৎসাহ প্রদান ইত্যাদি।
সুপারিশ ও পর্যবেক্ষণে বেশ কিছু ইতিবাচক দিক থাকলেও তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি, পূর্ব বাংলার প্রতি পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর নিপীড়নমূলক আচরণ এবং সার্বিক কার্যক্রমের প্রেক্ষাপটে শরীফ কমিশনের রিপোর্টটিকে ছাত্রসমাজ সচেতনভাবে শিক্ষা সঙ্কোচন ও বৈষম্যমূলক বলে প্রত্যাখ্যান করে। ধীরে ধীরে গড়ে উঠতে থাকে আন্দোলন। মূল রাজনৈতিক নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে সাধারণ ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সফল হরতাল পালিত হয়, ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। পুলিশের গুলিতে ঢাকায় নবকুমার ইনস্টিটিউটের ছাত্র নিহত হয়, গুলিবিদ্ধ হন বাস কন্ডাক্টর গোলাম মোস্তফা ও গৃহকর্মী ওয়াজিউল্লাহ, যিনি পরে হাসপাতালে মারা যান। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে জননেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী করাচি থেকে ঢাকা এসে গভর্নর গোলাম ফারুকের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন, রিপোর্টটির বাস্তবায়ন স্থগিত করা হয়।
এই সংক্ষিপ্ত বর্ণনার ধারাবাহিকতায় দেশে বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষা পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার পরিবেশ এটি নয়। শুধু ওপরে বর্ণিত শরীফ কমিশনের কিছু সুপারিশের নির্যাস দেশের বিদ্যমান শিক্ষা পরিস্থিতি এবং হালের আলোচিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর (বা শিক্ষার্থীদের ওপর?) ভ্যাট আরোপের সিদ্ধান্তগুলো কী প্রমাণ করে যা আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বা শিক্ষা সম্পর্কিত সিদ্ধান্তগুলো ভূতের কবলে পড়েছে? সাদা চোখে আমরা কেউ ভূত দেখিনি বটে, তবে শুনেছি যে ভূতের শ্রীচরণযুগল নাকি পেছনের দিকে! শরীফ কমিশনের সুপারিশের প্রতিবাদের যে রক্তক্ষয়ী ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তার ওপর আরোপিত অভিযোগটিই ছিল, এটি শিক্ষা সঙ্কোচনমূলক, শিক্ষাকে শিল্প বিনিয়োগের মতোই লাভ-ক্ষতির পণ্য বানিয়ে ফেলতে চেয়েছে। আমাদের আজকের শিক্ষা পরিস্থিতি কি জানান দেয়? অকল্পনীয় ব্যয়বহুল ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল বা ভ্যাট আরোপের দর্শনের ভিত্তিই বা কোথায়? শিক্ষা ও রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারকদের মন-মগজে কি তবে শরীফ কমিশনের সুপারিশগুলোই খেলা করছে? না হলে আমাদের সার্বিক শিক্ষা পরিস্থিতির সঙ্গে শরীফ কমিশনের মৌলিক দর্শনের এত মিল কীভাবে সম্ভব?
শিক্ষা ব্যবস্থার কিছু মৌলিক বিষয় আছে, যেখানে হস্তক্ষেপ করা যায় না। কোনো একটি বিষয়ে সবাই একমত নাও হতে পারেন। তবে একটি সাধারণ ঐকমত্য না হলে সে বিষয়ের বাস্তবায়ন ও সুফল লাভ কখনোই সম্ভবপর হয় না। শিক্ষা ব্যবস্থা তেমনই একটি বিষয়। এটি একটি জাতির অস্তিত্ব ও স্বাতন্ত্র্যের পরিচয় বিশেষ। তাই উন্নত বিশ্ব বলে পরিচিত জনগোষ্ঠীর শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক চরিত্র বা রূপ খুব সহজে পরিবর্তন হতে দেখা যায় না। একটি বিশেষ শিক্ষা ব্যবস্থা বা নীতি মোটামুটি একটি প্রজন্ম পার করে দেয় খুঁটিনাটি চুনকামের কথা বাদ দিলে। আর আমাদের দেশে শিক্ষা কাঠামো পরিবর্তনের বিষয়টি যেন খেলোয়াড়দের দলবদলের মতো করে পরিবর্তনের একটা চরম ছেলেখেলার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাধীনতার এই ৪৪ বছরে গড়ে ৫-৬ বছরে একটি করে ‘শক্তিশালী’ শিক্ষা কমিশন বা কমিটি গঠিত হয়েছে, রিমের পর রিম কাগজে ছাপা হয়েছে এসবের সুপারিশমালা এবং এগুলোর বহুসংখ্যক সুপারিশ অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। স্বাধীনতার পরপরই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খুদার নেতৃত্বে গঠিত হয় দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন। এর পর পর্যায়ক্রমে ১৯৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি, ১৯৮২ সালে ড. মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭ সালে ড. মফিজউদ্দিন খানের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭ সালে প্রফেসর শামসুল হকের নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিশন, ২০০১ সালে প্রফেসর এম এ বারির নেতৃত্বে জাতীয় শিক্ষা কমিটি, ২০০৩ সালে প্রফেসর মনিরুজ্জামান মিঞার নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ জাতীয় অধ্যাপক প্রফেসর কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। এসব কমিশন বা কমিটিতে দেশবরেণ্য ব্যক্তিরা সদস্য ছিলেন। তাদের কেউ কেউ আমাদের অনেকেরই সরাসরি শিক্ষক। তারা প্রত্যেকেই নিজ নিজ বিবেচনায় বিভিন্ন সুপারিশ তৎকালীন রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের কাছে পেশ করেছেন। সেগুলো কিছু বাস্তবায়িত হয়েছে, কিছু অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে আমার কথা ভিন্ন, শিক্ষার মতো একটি জাতীয় এজেন্ডার ক্ষেত্রে গড়ে পাঁচ থেকে ছয় বছরে নীতি পরিবর্তনের উদ্যোগ বা আয়োজন কোনো আত্মবিশ্বাসী ঐক্যবদ্ধ ও ভবিষ্যৎমুখী জাতির পরিচয় হতে পারে না। এটা বরং এক ধরনের অস্থিরতা, সাময়িক নিষ্কৃতি বা চমক সষ্টির প্রবণতার পরিচয়বাহী।
ভাবতে অবাক লাগে, একটি স্বাধীন দেশে গোটা চার দশকজুড়ে কোনো শিক্ষানীতি ছিল না। শিক্ষানীতি নিয়ে ভাবতে ভাবতেই কেটে গেল চার-চারটি দশক। প্রফেসর কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে প্রণীত শিক্ষানীতি ২০১০ কি শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতকে একটি শক্ত অবস্থানে নিয়ে যেতে পারবে? আর কিছু না হোক শিক্ষার্থীদের বিশেষ করে কোমলমতি স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের নোট, গাইড ও কোচিংনির্ভরতা কমাতে পারবে?
ঢালাও মন্তব্য না করে কিছু সুর্নিদিষ্ট বিষয়ে ফিরে আসি। আবেগ আর মধ্যবিত্তসুলভ কল্পনা বিলাসিতায় গা না ভাসিয়ে দেখতে চাই আমাদের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার স্বরূপটি কী? প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী এবং জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা প্রচলনের নিট অর্জন কী? ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা কোচিং সেন্টার আর নানা বাহারি মোড়কের নোট বইয়ের দৌরাত্ম্যে মূল বই হারিয়ে যেতে বসেছে। গোটা শিক্ষা ব্যবস্থাটা নোট-গাইডসর্বস্ব হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যমান শিক্ষানীতি কি তাহলে আমরা মেনে চলছি না? শিক্ষানীতিতে কি নোট, গাইড, কোচিং, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক প্রাইভেট পড়ানো এসব লেখা আছে? তা না হলে খোলাখুলিভাবে এসব চলছে কেন? দেশে কি জাতীয় কোনো শিক্ষা কর্তৃপক্ষ নেই? তাহলে জাতীয় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন বোর্ড বা শিক্ষা বোর্ডের কাজ কী? শিক্ষা ব্যবস্থা কি শুধু সার্টিফিকেটসর্বস্ব? নোট, গাইড এবং কোচিং সেন্টার যদি ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার সব দায়িত্ব নিয়েই নেয় তাহলে বিশাল বিশাল সাইনবোর্ডধারী এসব বোর্ডের দরকার কী? নোট, গাইড ও কোচিংয়ের পেছনে ব্যয়িত অর্থই বাড়তি খরচ। সাধারণ আয়ের অভিভাবকদের ওপর বাড়তি এই নির্যাতনের দায় কার? এটা কি বিদ্যমান শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতা নয়?
পাঠ্যসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে একটি দেশের জাতীয় চাহিদা, সমকালীন ও সমকালীন বিশ্ব বাস্তবতার পাশাপাশি সেই দেশের শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক গঠন তথা পুষ্টি পরিস্থিতিও বিবেচনায় রাখা অত্যাবশ্যক। দেশ ও বিশ্বের নানামুখী বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের অবশ্যই অনেক বিষয়ই অধ্যয়ন করা প্রয়োজন; কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার শিশু-কিশোরদের তুলনায় আমাদের শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক গঠন তথা পুষ্টির বিষয়টি উপেক্ষা করে তাদের ওপর একের পর এক বিষয় ও বইয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া কোন ধরনের শিক্ষা? এ দেশের স্কুলেও পাঠ্যসূচি প্রণয়নের জন্য বিভিন্ন প্রকল্পের ছত্রছায়ায় ইউরোপ-আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণের বাহারি বিলাস কবে বন্ধ হবে? একের পর এক সরকার পরিবর্তন হয়, সংবিধান পরিবর্তন হয়, বিভিন্ন সেস্নাগানও পরিবর্তন হয়; কিন্তু শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রকল্পের নামে এই হরিলুট-স্বেচ্ছাচার আর বন্ধ হলো না। সবাই যেন শিক্ষা বাণিজ্য নিয়ে আত্মমগ্ন হয়ে শিক্ষার জাতীয় ইস্যুতে আত্মসমর্পণ করে বসে আছে!
দেশে প্রচলিত ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলোর পাঠ্যসূচি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দেশীয় বিষয় নিয়ে সেসব পুস্তক রচিত হয় না বললেই চলে। সব বিদেশি লেখক তথা ভারতীয় লেখকের ভারতীয় ইতিহাস, ভূগোলসহ আরও কত সমাচার। আমাদের দেশে কি স্কুল পর্যায়ের ইংরেজি মাধ্যমের পুস্তক প্রণয়নের লেখক নেই? না বিষয় নেই? কোথায় আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, ভূগোল, সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, খেলাধুলা? তাহলে প্রশ্ন, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা কি স্কুল পর্যায়ের ইংরেজি পুস্তক লেখক তৈরি করতে পারল না। এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান যে, আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা বিরাট এক ইংলিশ ডিভাইড তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। ইংরেজি জানা গোষ্ঠী এবং ইংরেজি না জানা গোষ্ঠী। এ ডিভাইডের কারণে হয়তো ইংরেজি ভালো জানে না বলে একজন মেধাবী ছাত্র ইংরেজি জানা অমেধাবীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পেরে উঠছে না। এই বৈষম্য আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থারই সৃষ্টি। না হয় একজন ছাত্র সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেও অন্য বিষয়ে সাফল্য দেখাতে পারলেও ইংরেজিতে পারছে না কেন? এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে ভেবে দেখতে হবে। ডিজিটাল ডিভাইডের ক্ষেত্রেও এ কথাটা প্রযোজ্য। প্রযুক্তিগত বিদ্যাও আমাদের শিক্ষার একটা মূল হাতিয়ার।
এবারের ভ্যাটবিরোধী আন্দোলন কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ দিক সামনে এনেছে। এতদিন বেসরকারি শিক্ষা খাতের দরকষাকষির সামর্থ্য এদেশের নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় তেমন গুরুত্ব পায়নি, এবার সেই ধারণার পরিবর্তন হবে। পাশাপাশি বিদ্যমান নীতিমালা উপেক্ষা করে রাজনৈতিক ও আর্থিক(!) বিবেচনায় ঢাকা মহানগরজুড়ে (ব্যতিক্রমী দৃষ্টান্ত বাদে) ব্যবসা শিক্ষা ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থানগত গুরুত্ব নীতিনির্ধারকদের বিবেচনায় আনতে হবে। উপরন্তু ভবিষ্যতে যে কোনো শিক্ষা সংস্কারের ক্ষেত্রে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এই সাময়িক দরকষাকষির শক্তিকে হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে।
দক্ষ জনশক্তির গালভরা অভিধা নিয়ে শুধু বলতে চাই যে, অপরের দেশ গড়ে তুলতে ইটভাঙা দিনমজুর রফতানি করে আমরা বেশ টু-পাইস কামিয়ে নিচ্ছি ঠিকই; কিন্তু আমাদের সর্বোচ্চ রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক খাতের মধ্য ও জ্যেষ্ঠ পর্যায়ের জনশক্তি আজও বিদেশি। আমাদের শ্রমিকদের আয়ের একটা বিরাট অংশ ওইসব বিদেশি জনশক্তির বেতন-ভাতা বাবদ বিদেশে চলে যাচ্ছে। এই হার বাড়ছে ক্রমাগত। ইট ভাঙার কায়িক শ্রমিক, গৃহকর্মী, অদক্ষ রঙমিস্ত্রি, নির্মাণ শ্রমিক, দোকানি আর ট্যাঙ্ িড্রাইভার বানানোর শিক্ষা দিয়ে আর যাই হোক ১৯৬২-এর শিক্ষা আন্দোলনের ঋণ শোধ হবে না। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এদেশে কর্মরত বিদেশি দক্ষ জনশক্তি প্রতি বছর ৩২ হাজার কোটি টাকা নিয়ে যাচ্ছে। তাহলে এদেশের সঞ্চয়ের ছোট বাঙ্টিতে থাকে কয় টাকা? আমাদের শ্রমবাজার থেকে বিদেশে চলে যাওয়া টাকার এই পরিমাণ আমাদের জাতীয় বাজেটের ১০ শতাংশের ওপর। এ বিষয়টি নিয়ে জনমত পর্যায়ে তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই। অর্থাৎ বিষয়টি নিয়ে আমরা তেমন সচেতন নই। নিজের দেশ নিজে গড়ে তোলা, নিজের স্বপ্নের রঙে নিজের দেশকে সাজিয়ে তোলার মতো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে আমাদের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা নিদারুণ ব্যর্থ হয়েছে। এ সত্য আর কি দিয়ে ঢাকবেন?
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের মূল চেতনা ছিল একটি বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। রূঢ় বাস্তবতা এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্ব পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে শুধু সংখ্যায় নয়, গুণগতমান নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে সব দ্বিধাদ্বন্দ্ব ভুলে একটি মানানসই বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করতেই হবে। কিন্তু তা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হবে না। আমাদের সামনে দৃষ্টান্ত আছে বেগম রোকেয়া, ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, স্যার সৈয়দ আহমদ এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। তাদের অনুসরণ করে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বড় ধরনের একটা সংস্কার আনতে হবে। অন্যথায় আমরা পিছিয়ে যাব। শুধু ক্রিকেট দলের সাফল্যের জন্য দল মত নির্বিশেষে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, তা হলে আগামী দিনের শক্তিশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে একটি লাগসই শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনে আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে পারব না কেন?
প্রকল্পের নামে হরিলুট নয়, শিক্ষার্থীদের গিনিপিগ আর শৈশব-কৈশোর লুণ্ঠনকারী, পুস্তকের ভারবাহী রোবট বানানো নয়, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নাগরিকরূপে গড়ে উঠতে লাগসই শিক্ষা ব্যবস্থার দাবিতে একটি শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন শুরুর এখনই সময়। কে করবে এই আন্দোলন? কোনো সরকার নয়, কোনো বিদেশি অর্থপুষ্ট এনজিও নয়, কোনো প্রকল্পখেকো চক্র নয়, এই আন্দোলন করবে জাতির সর্বস্তরের মানুষ, শিক্ষা নিয়ে, জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাশীল ব্যক্তিবর্গ, ছাত্র-শিক্ষক অভিভাবক সবাই। কারণ শিক্ষাই একটি জাতির শ্রেষ্ঠ রসদ, যা তার বেঁচে থাকার জ্বালানি। পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ঘুণে ধরা ব্যবস্থা বদলাতেও সমাজের সচেতন মহলের সোচ্চার হতে হবে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে ভিসি নিয়োগে এবং অপসারণের যে পদ্ধতি ব্যবহৃত হয়ে আসছে তা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। রাজনৈতিক দলের প্রভাবপুষ্ট হয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত ভিসিরা সর্বজনগ্রাহ্য হয়ে উঠতে পারছেন না। রাজনৈতিক দলীয় প্রভাব বলয়েই থেকে যাচ্ছেন। এতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় বৈশিষ্ট্য হারিয়ে দলীয় বৈশিষ্ট্যম-িত হচ্ছে, যা একটি জাতীয় শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য মঙ্গলজনক নয়। এদেশের বিশিষ্ট নাগরিকদের সামনে আজ এই চ্যালেঞ্জ আগামী দিনের একটি সক্ষম ও সফল বাংলাদেশ বিনির্মাণে সবাইকেই এগিয়ে আসতে হবে। তাই আর বিলম্ব না করে শিক্ষা ক্ষেত্রে একটি ব্যাপকভিত্তিক জাতীয় শিক্ষা সংস্কার আন্দোলন এখন সময়ের দাবি।
শিক্ষার্থীদের দিকে তাকিয়ে বলতে হচ্ছে, ‘পাখী কি আর চেঁচামেচি করে? পাখী কি আর দুর্বিনীত আচরণ করে?’ মহারাজের প্রশ্নের জবাবে পারিষদরা বললেন, ‘না মহারাজ পাখী এখন শান্ত। কোনো ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করে না। ডানা ঝাপটায় না।’ মহারাজ বললেন, ‘পাখীটির উচিত শিক্ষা হয়েছে।’ (তোতা কাহিনী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
আমরা আমাদের শিক্ষার্থীদের সেই পাখিটি বানিয়ে ফেলছি না তো?
শাওয়াল খান : অনুবাদক, শিক্ষা-গবেষক
মন্তব্য করুন