মো. আফলাতুন
অষ্টম বেতন স্কেল নিয়ে শিক্ষক সমাজ সোচ্চার হয়েছেন ভালো কথা। মনে হচ্ছে, অবশেষে কুম্ভকর্ণের ঘুম ভাঙল। দেশের সংবিধান আছে, আইন আছে আরও আছে আইন প্রয়োগের জন্য অস্ত্রধারী লোকজন। বাংলাদেশের যে Warrant of Precedence আছে তাতে সম্মানিত শিক্ষক সমাজের অবস্থান কোথায়, তা কি একবারও পড়ে দেখেছেন? রাষ্ট্রের সম্মান-মর্যাদা কে কতটা পাবেন, তা তো নির্ধারিত হয় Warrant of Precedence দ্বারাই। ফখরুদ্দীন-মঈনউদ্দিন সরকারের সময় মঈন সাহেব তার র্যাঙ্ক একধাপ বাড়িয়ে নিয়েছেন নিছক ক্ষমতাবলে। আমাদের দ-মু-ের কর্তা সচিব সাহেবরা ও তাদের সাবেক সহকর্মী বড় ভাই অর্থমন্ত্রীর মাধ্যমে অষ্টম বেতন স্কেলের আড়ালে নিজেদের তিন ধাপ এগিয়ে নিলেন ক্ষমতার বলে। শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সমাজের ক্ষমতা নেই, তাই তাদের চিন্তা শুধু বেতন নিয়ে আর কীভাবে এক গ্রেড উপরের সিলেকশন গ্রেড পাবেন, তা নিয়ে। শিক্ষক সমাজের প্রাণের দাবি হওয়া উচিত ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে সুস্পষ্ট অবস্থান নিশ্চিতকরণ এবং তা এখনই। তাহলে আরেকবার দেখে নেয়া যাক ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স কী?
ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স
মোগল আমল থেকেই ভারতবর্ষে ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স ছিল। রাষ্ট্রাচারে কে কতটা গুরুত্ব পাবেন বা কে কার আগে বসবেন, তা ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স দ্বারা নির্ধারিত হতো। মোগল আমলের এ তালিকা ১৮৬১ সালে সংশোধিত হয় ব্রিটিশদের দ্বারা, ব্রিটিশদের মতো করেই। ইংরেজরা বাণিজ্য করতে এসে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে এবং অস্ত্রধারী ক্ষমতাসীনদের ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সি সামনের সারিতে নিয়ে আসে। পেছনে পড়ে যায় আমজনতা। তালিকার ১২ নম্বরে আছেন কেবিনেট সেক্রেটারি, ১৩ নম্বরে জাতীয় সংসদ সদস্য (জনগণের ভোটে নির্বাচিত বা অনির্বাচিত)। তালিকার ১৬, ১৭, ১৮, ১৯, ২০, ২১, ২২, ২৩, ২৪ ও ২৫ নম্বরে সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কথা বলা হয়েছে। দ্ইু-দুইবার (১৯৫৭, ১৯৭১) স্বাধীনতা লাভ করার পরও এতে আর সংশোধনী তেমন আনা হয়নি। অর্থাৎ ব্রিটিশ প্রভুর নিয়মেই চলছে সোনার বাংলা, যেখানে ক্যাডার সার্ভিসের শিক্ষক সমাজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কোনো শিক্ষককেই তালিকায় কোনো স্থান দেয়া হয়নি। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, আমরা সবাই বলার সময় বলি শিক্ষকরাই শ্রেষ্ঠ, জাতি গড়ার কারিগর ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু অনুষ্ঠানে এমনকি থানা পর্যায়ের কোনো মিটিংয়েও সরকারি কলেজের অধ্যক্ষের জন্য কোনো চেয়ার বরাদ্দ থাকে না, কারণ তিনি যে লিস্টের বাইরে। তাই বলে শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে থাকেন না, তাদের একখানা দয়ার চেয়ার দেন তারই কনিষ্ঠ ছাত্রবয়সী বা পুত্রসম উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা।
ইংরেজ আমল বা মোগল আমলে শিক্ষকদের জন্য ইজ্জত ছিল। বাদশাহ আলমগীর শিক্ষককে কীভাবে সম্মানিত করেছেন, তা আমরা সবাই জানি। ইংরেজরাও প্রয়োজনে শিক্ষকদের ইজ্জত করতে জানেন। যেমনটা করেছিলেন উইন্সটন চার্চিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যিনি ছিলেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী একমাত্র রাজনীতিবিদও ছিলেন চার্চিল। চার্চিলের সময়ের একটা ঘটনা বলি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চার্চিল হুকুম দিলেন বিশালাকার বাঙ্কার তৈরি করতে। বাঙ্কার নির্মাণ হয়ে গেল। জল্পনা-কল্পনা চলল এ বাঙ্কারে থাকবে কে বা কারা। মন্ত্রী-মিনিস্টার, রাজনীতিবিদরা ভাবলেন সম্ভবত তারাই থাকবেন, সামরিক-বেসামরিক কর্তাব্যক্তিরা ভাবলেন তারাই থাকবেন। কিন্তু না চার্চিল ঘোষণা দিলেন এ বাঙ্কারে থাকবেন জাতির শ্রেষ্ঠ গৌরব শিক্ষকরা। কারণ শিক্ষকদের সুরক্ষা না দিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলবেন কে? অথচ আজ আমরা দেখি বাচ্চা ছেলে সহকারী কমিশনারের পা ধরে বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, এমনকি ক্যাডার সার্ভিসের শিক্ষক। হৃদয়ের এ রক্তক্ষরণ আর চলতে দেয়া যায় না। শিক্ষক সমাজের মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে যারা জোড়াতালির বেতন স্কেল আর সিলেকশন গ্রেডের দাবি তুলছেন তারা মূলত নিজেদের পায়ে কুঠার মারার চেষ্টা করছেন বৈ অন্য কিছু নয়।
পিএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়া ত্রুটিমুক্ত নয়। প্রশ্ন ফাঁস, তদবির ইত্যাদি বাদ দিলেও ‘শুধু বিদ্যমান কোটা ব্যবস্থার কারণেই আমাদের প্রশাসনে মেধাবীদের চেয়ে অমেধাবীরা জায়গা করে নিচ্ছেন’- এটা লেখকের কথা নয়- এ হচ্ছে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদারের কথা। তাই শুধু বেতনবৈষম্য নয়, চতুর্থ গ্রেড প্রাপ্তি নয়, আজ সবাইকে দাবি তুলতে হবে শিক্ষা প্রশাসন চলবে শিক্ষকদের নেতৃত্বে। শিক্ষা সচিব হবেন শিক্ষকরাই। অথবা উপসচিব পর্যায়ে গিয়ে আবারও প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে (ISSB স্টাইলেও হতে পারে) সব ক্যাডারের মধ্য থেকে প্রশাসন পরিচালনার জন্য সৎ, যোগ্য, দক্ষ কর্মকর্তা বাছাই করা হোক। তাহলেই জনগণ যথার্থ সেবা পেতে পারেন।
সবশেষে বলতে চাই, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স সংশোধনের মাধ্যমে শিক্ষকদের যোগ্য সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। আশা করি, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, আমাদের অভিভাবক শিক্ষামন্ত্রী বা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল শিক্ষাসচিব আমাদের ন্যায্য দাবির প্রতি সংহতি প্রকাশ করবেন এবং বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন।
মো. আফলাতুন : সহযোগী অধ্যাপক সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, রংপুর
মন্তব্য করুন