শুক্রবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী ২০২৫, ০১:২২ পূর্বাহ্ন
প্রশাসনের নিচ থেকে উপর পর্যন্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে সরকারবিরোধী অনেক কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। এসব কর্মকর্তা ভালো ভালো জায়গায় পদায়ন নিয়ে ভিতরে ভিতরে কার্যত সরকারের বিরুদ্ধেই তৎপর। বিশেষ করে সরকারি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে নিজেদের অনুসারী লোকজনদের বসিয়ে দল ভারী করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বর্ণচোরা এসব কর্মকর্তার কারণেই সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজেই সমন্বয়হীনতা দেখা দিচ্ছে। সরকারের অনুসারী প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, ঘাপটি মেরে থাকা সরকারবিরোধী কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে কৌশলে কাজ করে যাচ্ছেন। তারা সুযোগ পেলেই সরকারের ক্ষতি করছেন। সরকারের সমর্থক হিসেবে পরিচিত কতিপয় কর্মকর্তা সরকারবিরোধী এসব কর্মকর্তাকে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। আর এই সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছেন সরকারবিরোধীরা। গত কয়েকদিনে প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে ও অনুসন্ধান চালিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়েই ঘাপটি মেরে আছেন সরকারবিরোধী একাধিক কর্মকর্তা। যারা গুরুত্বপূর্ণ এই মন্ত্রণালয়ে বদলি, পদায়ন ও পদোন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। নিজেদের পছন্দের কর্মকর্তাদের সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর মন্ত্রণালয় ও দফতরে পদায়ন করছেন। জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডির সঙ্গে যোগসাজশ করে ওই মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা নিজেদের পছন্দের ও দলীয় অনুসারীদের ভালো জায়গায় পদায়নে ভূমিকা রাখছেন।
সূত্র জানায়, এপিডি উইংয়ের প্রভাবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আনিসুল হকের একান্ত সচিব (পিএস) হিসেবে পদায়ন পেয়েছেন প্রশাসনের ২২তম ব্যাচের কর্মকর্তা শামসুল ইসলাম মেহেদী। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তিনি ছাত্রজীবনে ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে জানা গেছে। জানা গেছে, এক সময় সরকারের একজন শিক্ষা সচিবের একান্ত সচিব (পিএস) ছিলেন কবির আহমদ। তিনি প্রায় ছয় মাস আগে প্রাইজ পোস্টিং পেয়েছেন বিদেশের একটি দূতাবাসে। থাইল্যান্ড দূতাবাসে অর্থনৈতিক কনস্যুলার হিসেবে পোস্টিং পাওয়া কবির ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রদলের সক্রিয় সংগঠক। গত ১৬ সেপ্টেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে কে এম জাহাঙ্গীর আলম নামে একজনকে। যিনি বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী রেদোয়ান আহমেদের সহযোগিতায় বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কর্মচারী হিসেবে প্রেষণে নিয়োগ পান। কুমিল্লার চান্দিনার নাওতলা গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর বিগত মহাজোট সরকারের সময় তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীর দফতরে কর্মরত ছিলেন। বিস্ময়ের বিষয় হচ্ছে, প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া সেই কর্মচারীই এখন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীর এপিএস। আর তার এই নিয়োগে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। স্থানীয় সরকার বিভাগে কর্মরত সিনিয়র সহকারী সচিব জাহিদ হোসেন ২২তম বিসিএসে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করা এই কর্মকর্তা একসময় যশোরে কর্মরত ছিলেন। বর্তমান এপিডি মহিবুল হকও একসময় যশোরের জেলা প্রশাসক ছিলেন। সেই সূত্রে দুজনের ঘনিষ্ঠতা। এরই সূত্র ধরে মহিবুল হক জাহিদ হোসেনকে ঢাকায় এনে স্থানীয় সরকার বিভাগে পোস্টিং দেন। ছাত্রজীবনে তিনি সক্রিয় ছিলেন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে। তিনি এখন স্থানীয় সরকার বিভাগে বেশ দাপুটে কর্মকর্তা। তিনি অনেক বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বলে জানা গেছে। বাণিজ্যমন্ত্রীর একান্ত সচিব ৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা মুন্সী সফিউল হক। বিগত বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে জাতীয় সংসদের হুইপ রেজাউল বারী ডিনার একান্ত সচিব ছিলেন। ৮৫ ব্যাচের কর্মকর্তা শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরের পরিচালক যুগ্ম-সচিব আবদুল মান্নান ছাত্রজীবনে ছিলেন ছাত্রশিবিরের সক্রিয় কর্মী। ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তাজুল ইসলাম, তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মাহবুবুল আলম দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপি-জামায়াত আমলেও তারা ছিলেন প্রভাবশালী। সেই প্রভাব এখনো বহাল। নবম ব্যাচের কর্মকর্তা যুগ্ম-সচিব মো. মহসিন ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। তিনি বিএনপি আমলে সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমানের একান্ত সচিব ছিলেন। নোমানের দুই মেয়াদেই তিনি একান্ত সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। ৮২ ব্যাচের কর্মকর্তা জালাল আহমেদ অর্থ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এই কর্মকর্তা কুড়িগ্রাম ও ফরিদপুর জেলার জেলা প্রশাসক ছিলেন। ৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব এ আর এম নজমুস ছাকিব ২৫ বছর ধরে অর্থমন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন। সরকারবিরোধী কর্মকর্তা হিসেবে তার পরিচিতি আছে। ১৩ ব্যাচের কর্মকর্তা আবুল হাসান বর্তমানে পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগে উপ-সচিব হিসেবে কর্মরত। ছাত্রজীবনে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে বিতর্ক ও সাহিত্য সম্পাদক পদে নির্বাচন করেন। তিনি অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একান্ত সচিবও ছিলেন। বিতর্ক উঠার পর তাকে পিএস পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। দিনাজপুরের জেলা প্রশাসক মীর খায়রুল আলম ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ১১ ব্যাচের কর্মকর্তা জামালপুরের ডিসি মো. শাহাবুদ্দিন খান বিএনপির কট্টর সমর্থক। তার ভাই পিরোজপুরের নেছারাবাদের একটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এবং বিএনপি নেতা। তার গোটা পরিবারই বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রশাসনের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে যারা ছিলেন দাপুটে তারাই এখন বিভিন্নভাবে কৌশলে আবারও প্রশাসনে নিজেদের অবস্থান পাকাপোক্ত করছেন। সরকারের যে কোনো দুর্যোগ সময়ে এই কর্মকর্তারাই সরকারকে বেশি বেকায়দায় ফেলতে পারেন বলে আশঙ্কা সরকার সমর্থকদের।
মন্তব্য করুন