পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিস ইন্টেলিজেন্স (আইএসআই)এর নির্দেশেই জামাত-উল-মুজাহিদিন-বাংলাদেশ (জেএমবি) পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও বাংলাদেশে সক্রিয় বলে জানিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দারা । গোয়েন্দা সুত্রগুলো বলছে, ভারতে ঢুকতে এসব জঙ্গিরা নিরাপদ রুট হিসেবে বাংলাদেশের সাতক্ষীরাকে ব্যবহার করছে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের জেরায় পাকিস্তানের চরদের দেওয়া তথ্যমতে, সাতক্ষীরা শেখ হাসিনার মাথা ব্যাথা হতে পারে। কারণ এই জঙ্গিদের নাশকতার তালিকায় আছে বাংলাদেশও।
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের পরিকল্পনা করেছেন, তথ্যপ্রমাণসহ এ বিষয়ে পাকিস্তানের নিরাপত্তা উপদেষ্টার ব্যাখ্যা চাইবেন তিনি।
গোয়েন্দা সূত্র মতে, আইএসআই এক দিকে পশ্চিমবঙ্গ ও আসামে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে। অন্য দিকে এই রাজ্যগুলিকে ভিত্তি করে বাংলাদেশে নাশকতা তৈরিরও চেষ্টা করছে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, শেখ হাসিনার সময়ে সন্ত্রাস দমনে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বোঝাপড়া মজবুত হওয়ার পর থেকেই এই অঞ্চলে আইএসআই আরও বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে।
এদিকে পাকিস্তানি চর মহম্মদ ইজাজ সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে কিভাবে বসিরহাটে নদী পার হয়ে কলকাতায় ঢুকেছে সেই তদন্ত শুরু করলেন বিএসএফ-এর গোয়েন্দারা৷
তাদের অভিযোগ, এর জন্য দায়ী কোনও ঘাট মালিক৷ তারই সাহায্য নিয়ে ওই আইএসআই এজেন্ট প্রবেশ করেছে পশ্চিমবঙ্গে৷
গোয়েন্দাদের আরও দাবি, বিএসএফ ও বাংলাদেশের দিকে বিজিবি পাহারা দিলেও গভীর রাতে ঘাট মালিকরাই আইএসআই এজেন্ট ও জঙ্গিদের নৌকায় সীমান্ত পার করানোর ব্যবস্থা করে দেয়৷ এমনকী ইরশাদের দাদা ইরফানও উত্তর ২৪ পরগনার নদীপথ ধরেই একাধিকবার অনুপ্রবেশ করেছে বলে অভিযোগ উঠেছে৷
ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের জলপথে আইএসআই এজেন্ট ও জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ রুখতে এবার আরও কড়া ব্যবস্থা নিচ্ছে বিএসএফ৷ যে ঘাট মালিকরা ওই পাকিস্তানের চরদের এই রাজ্যে ঢুকতে সাহায্য করছে, তাদেরও সন্ধান চালাচ্ছেন বিএসএফ-এর গোয়েন্দারা৷
আটককৃতরা জেরায় জানিয়েছে, কলকাতা থেকে আটস পাক এজেন্ট মহম্মদ ইজাজ ২০১৩ সালে বাংলাদেশ হয়ে নদীপথে ভারতে ঢোকে । কলকাতার মেটিয়াবুরুজের মহম্মদ ইরশাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ইজাজ। ইরশাদের ছেলে আসফাক এবং এক আত্মীয় জাহাঙ্গিরের সাহায্যে সে ভারতের পরিচয়পত্র তৈরি করে। অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্সে কাজ শুরু করে। এই সময়েই ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য ও ছবি ইজাজ পাকিস্তানে পাচার করে বলে অভিযোগ। এই বছরের গোড়ায় বেরিলিতে চলে যায় মহম্মদ ইজাজ। সেখানে সুখোই যুদ্ধবিমান সংক্রান্ত বহু তথ্য সে পাচার করেছে বলে অভিযোগ।
কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের বক্তব্য, বর্ধমানের আগে জেহাদি জঙ্গি-সংগঠনগুলি সেভাবে নাশকতা না ঘটালেও কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ বরাবরই আইএসআই-এর আঁতুড়ঘর তথা নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে কাজ করে এসেছে। বামফ্রন্ট জমানায় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এ বিষয়ে উদ্বেগও প্রকাশ করেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থানই এর বড় কারণ। উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি তোবটেই, বাংলাদেশের সঙ্গেও যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হওয়ায় পশ্চিমবঙ্গ বহু দিন ধরেই আইএসআই-জঙ্গিদের নজরে।
ভারতীয় গোয়েন্দাদের দাবি, বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলার ভারত বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়েই গত কয়েক বছরে বেশ কিছু পাকিস্তানি ও বাংলাদেশি আইএসআই এজেণ্ট নদীপথে ঢুকেছে কলকাতায়৷
বিএসএফ গোয়েন্দারা জানিয়েছেন, এবার থেকে ইছামতী-সহ বেশ কিছু নদীর ঘাট মালিকদের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে৷ দিনের বেলা ছাড়াও রাতের অন্ধকারে অনুপ্রবেশ রুখতে নজরদারি বাড়ানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিএসএফ গোয়েন্দারা৷আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা জেলা জঙ্গিদের নিরাপদ রুট হিসাবে ব্যবহার হয়ে এসেছে৷
ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ইতিমধ্যেই কলকাতা থেকে আটক ইরশাদ আনসারি, আসফাক ও মহম্মদ জাহাঙ্গির সম্পর্কে বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরির নির্দেশ দিয়েছেন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে। আইএসআই পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে কিভাবে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে, তার তথ্যপ্রমাণ-সহ একটি ‘ডসিয়ার’ তৈরি করছেন দোভাল। ওই ‘ডসিয়ার’টি আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের সন্ত্রাসে মদত প্রমাণে কাজে লাগাতে চায় নয়াদিল্লি।
ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গত বছর খাগড়াগড়ে বিস্ফোরণের আগে-পরে পশ্চিমবঙ্গে বড় কোনও নাশকতা না হলেও বেশ কিছু দিন ধরেই এই রাজ্য থেকে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলছে আইএসআই মদতপুষ্ট জঙ্গি সংগঠনের স্লিপার সেলগুলি। কলকাতার বড়বাজার থেকে বন্দর এলাকা— বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা স্লিপার সেলের সদস্যরা কখনও বিভিন্ন উৎসবের নাম করে, কখনও তোলাবাজির মাধ্যমে টাকা তুলছে। সেই টাকাই পরে গোটা দেশে জেহাদি কার্যকলাপে ব্যবহৃত হয়। এমনকি হাত ঘুরে বিদেশেও আল কায়দার মতো জঙ্গি সংগঠনগুলির তহবিলে জমা হয়।
গোয়েন্দারা বলছেন, আগে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে অনেক ফাঁকফোকর থাকায় আইএসআই-এর পক্ষে সন্ত্রাস পাচার করা তুলনায় সহজ ছিল। তা সে অস্ত্র, বিস্ফোরকই হোক বা কালো টাকা।
এখন সীমান্ত বরাবর অনেকটা অংশে কাঁটাতার বসে যাওয়ায় তাদের কিছুটা সমস্যা হলেও এখনও সীমান্তে যেটুকু ফাঁকফোকর রয়েছে, সেগুলিকে কাজে লাগাতেই সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশ এবং সীমান্তের এ দিকে পশ্চিমবঙ্গে জাল ছড়াচ্ছে আইএসআই।
দিল্লি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের হাতে আটক এমনই দু’জনকে জেরা করে চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। আটক কাফাইতুল্লা খান জানিয়েছে, আইএসআই এর হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির জন্য সে একাই ভারত জুড়ে ১২ জনকে ‘রিক্রুট’ করেছে। নতুন এজেন্টদের রিক্রুট করতেই সে ভোপালে যাচ্ছিল। কিন্তু, তার আগেই দিল্লি রেল স্টেশন থেকে তাকে গ্রেফতার করে দিল্লি পুলিশ।
গোয়েন্দাদের তথ্য অনুযায়ী, ভারতে প্রায় একশো জন পাক এজেন্ট এখন সক্রিয়। গুপ্তচর চক্রের খোঁজ পেতে গত এক সপ্তাহে উত্তরপ্রদেশের ১৮টি, পশ্চিমবঙ্গের ২৩টি, জম্মু কাশ্মীরের ১৫, দিল্লির ৭ এবং বিহারের ৫টি জায়গায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। আটক কাফাইতুল্লার মোবাইল ফোন এবং ল্যাপটপ খতিয়ে দেখেও চাঞ্চল্যকর তথ্য হাতে পেয়েছে দিল্লি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ।
জানা গিয়েছে, নিরাপত্তা এজেন্সিগুলির নজর এড়াতে পাকিস্তান গুপ্তচররা নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময় নানা ধরণের কোডওয়ার্ডের সাহায্য নিত। যেমন, ‘দবা’ অর্থাৎ ওষুধ কোডনেম ব্যবহার করা হত তথ্যের ক্ষেত্রে। তথ্য পাচারের ক্ষেত্রে বলা হত, ‘এক্স-রে’! তেমনই, পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা (আইএসআই) আধিকারিকদের কোডনেম ছিল ‘ভাইজান’। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোডনেম ছিল ‘ডক্টর’। বিএসএফ-এর কোডনেম ছিল ‘সার্জেন’।
আটককৃতদের কাছ থেকে নানা তথ্য যেমন যুদ্ধের প্রস্তুতি সংক্রান্ত তথ্য, সেনা জওয়ানদের সম্পর্কিত তথ্য, ভারতের যুদ্ধবিমান সম্পর্কিত তথ্য উদ্ধার হয়েছে।
জানা গেছে, আইএসআই-এর গুপ্তচরবৃত্তি সম্পর্কে প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে শিগরিরই বিস্তারিত জানাবে তিনবাহিনী।
বিবার্তা ডেস্ক:সূত্র: আনন্দ বাজার
মন্তব্য করুন