বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৫:০৬ অপরাহ্ন
প্রতিকী ছবি।
ওয়াহিদ রুবেল।।
পর্যটন শহর কক্সবাজারে আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দিন দিন চরমভাবে অবনতি হচ্ছে। প্রতিনিয়ত ঘটছে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, বীভৎস, বিকৃত, রোমহর্ষক রহস্যজনক খুনের ঘটনা। শুধু জুন-জুলাই দুইমাসে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে ৪০ টি। সর্বশেষ ২৯ আগস্ট কক্সবাজার সদর উপজেলার খুরুশকুল থেকে উদ্ধার করা হয় এক যুবকের মরদেহ। এরআগে ২১ আগস্ট কক্সবাজার শহরের হলিডে মোড় একটি আবাসিক হোটেল থেকে সাবেক পৌর আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিনের রহস্যজনক হত্যাকান্ডের পর নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে শংকিত হয়ে পড়ছে কক্সবাজারের মানুষ। এ হত্যাকান্ডের এখনো রহস্য বের করতে না পারলেও খুনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে আশরাফুল ইসলাম নামে একজনকে আটক করেছে পুলিশ। যদিও আটক যুবকের দেয়া জবানবন্দিতে পুলিশ দাবি করেছেন অনৈতিক কর্মকান্ডের প্রতিশোধ নিতেই সাইফুদ্দিনকে খুন করা হয়েছে। কিন্তু পুলিশের এ বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সাইফুদ্দিনের পরিবার।
জেলা আইন শৃঙ্খলা কমিটির সভায় জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, জুলাই মাসে গুরুতর অপরাধমূলক মামলা হয়েছিল ৪১৬টি। যেখানে খুনের ঘটনা ছিল ১৮টি। তৎমধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে খুনের ঘটনা ঘটেছে ৯টি। আর জুন মাসে এসে গুরুতর অপরাধে মামলা হয়েছে ২৯০টি। মামলা কমলেও হত্যাকান্ড বেড়ে হয়েছে ২২ টি। এছাড়া অপহরণ, ডাকাতি, ছিনতাই, দস্যুতা, অপমৃত্যু, ধর্ষণ, নারী ও শিশু নির্যাতনসহ ১৫ টি বিভিন্ন অপরাধের ঘটনা ঘটেছে ৭০৬ টি। রয়েছে অপমৃত্যু অহরহ ঘটনা। অপরদিকে ১৪ জুন থেকে ১১ আগস্ট পর্যন্ত দুই মাসে টেকনাফ উপজেলার সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, হোয়াইক্যং, বাহারছড়া, সেন্টমার্টিন ও উখিয়া উপজেলার ইনানী সমদ্রর সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ভেসে আসে ১১ জনের লাশ ও মানবকঙ্কাল। সবকিছু মিলে পুরো কক্সবাজার অনিরাপদ নগরীতে পরিণত হয়েছে। আর ছিনতাই আতংক রয়েছে কক্সবাজার শহরজুড়ে। পুলিশের দাবি আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাকি রয়েছে। অপরাধীদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এ দুইমাসে ৬৯৬ রাউন্ড গুলি/কার্তুজ, চারটি পিস্তল, ২৬ টি বন্দুক উদ্ধার করা হয়েছে। একই সাথে ছিনতাইয়ের স্পটগুলোর তালিকা করে সিসিটিভি ক্যামরার স্থাপন করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের দেয়া তথ্য মতে, ছিনতাইকারী চক্রের সদস্যরা দল-উপদলে ভাগ হয়ে কক্সবাজার শহরের বাস টার্মিনাল, উত্তরণ আবাসিক এলাকা, নতুন জেলগেট, বিজিবি ক্যাম্প এলাকার আমতলা, সাবমেরিন গেট, সিটি কলেজ গেট, আলীর জাহাল রোড, গরুর হলদা সড়ক, হাশেমিয়া মাদরাসা গেট, খুরুশকুল রাস্তার মাথা, টেকপাড়া মসজিদ রোড়, ম্যালেরিয়া অফিস সড়ক, বার্মিজ স্কুল রোড়, বৌদ্ধমন্দির সড়ক, হাসপাতাল সড়ক, ভোলা বাবুর পেট্রোলপাম্প, লালদীঘির পাড় ও গাড়ির মাঠের মুখ, হলিডে মোড়, সার্কিট হাউজ সড়কের ম্যাজিস্ট্রেট কলোনির সামনে, অরুণোদয় স্কুল, গোলচত্বর মাঠ, ডিসির ডাক বাংলো সড়কের মাথা, জইল্ল্যার দোকান মোড়, জাম্বুর মোড় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের মাথা, লাবণী মোড়, গোলদীঘির পাড়, বাজারঘাটাসহ ৩০টির অধিক স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বেশি।
তবে, হত্যাকান্ডের বেশিরভাই ব্যক্তিগত, জমিসংক্রান্ত বিরোধ ও মাদকের অর্থ জোগাড় ও পারিবারিক দ্ব›েদ্ব ঘটছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। বীভৎস হত্যাকান্ডকে সামাজিক অবক্ষয়ের প্রতিচ্ছবি বলেও মনে করেন তারা। এ ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আইনের কঠোর প্রয়োগ এবং সামাজিক-পারিবারিক মূল্যবোধ জোরালো করতে হবে। একই সাথে দ্রæত মামলা নিষ্পত্তির করা গেলে অপরাধের মাত্রা কিছুটা কমে আসবে বলে মনে করেন তারা।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিনের হত্যাকান্ড নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতাকে দায়ি করেছে কক্সবাজার-৩ আসনের সাংসদ সাইমুম সরওয়ার কমল। তিনি কক্সবাজারকে নিরাপদ রাখতে পুলিশসহ শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কঠোর পদক্ষেপ নিতে আহবান জানান।
কক্সবাজার জেলা বারের সিনিয়র আইনজীবী ও পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এড. ফরিদুল আলম বলেন, আমরা চেষ্টা করছি চাঞ্চল্যকর সব মামলাই নিষ্পত্তি করার। দীর্ঘ কয়েক যুগ আগের চাঞ্চল্যকর মামলাও সম্পন্ন করা হয়েছে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, পর্যটন নগরী হিসেবে কক্সবাজার ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চলাফেরার সুযোগ থাকা দরকার। পর্যটনের স্বার্থে যে কোনো মূল্যে এদের দমন করা দরকার।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ছিনতাই রোধে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে। দিনে-রাতে পুলিশের পাঁচ-ছয়টি টিম শহরের নিরাপত্তায় কাজ করছে। প্রতিদিনই সন্দেহভাজদের আটক করে যাচাইয়ের পর ছিনতাইকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা হচ্ছে।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রফিকুল ইসলামের বলেন, কক্সবাজার অন্য জেলা শহর থেকে একটু ভিন্ন। এখানকার অপরাধের ধরন ও অপরাধীদের বিচরণও অন্য রকম। অধিকাংশ ছিনতাইকারী আইনের চোখে অপ্রাপ্ত বয়স্ক। আমরা তাদের গ্রেফতার করে আদালতে পাঠাই। কিন্তু তারা জামিনে বেরিয়ে এসে ফের ছিনতাইয়ে জড়িয়ে পড়ে। কক্সবাজার শহরে যেসব স্থানে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে সেখানে সিসিটিভি স্থাপন করার পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।
পুলিশের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, যেসব খুনের ঘটনা ঘটছে পুলিশ তা তদন্ত করে অপরাধীকে আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। তবে সামাজিক সচেতনতা এবং বাবা-মা ও অভিভাবকদের দায়িত্বশীল ও ইতিবাচক আচরণ অপরাধ কমাতে ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।
মন্তব্য করুন