বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:০০ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি-দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত সাইফুদ্দিন।
ওয়াহিদ রুবেল।।
কক্সবাজার শহরের হলিডে মোড় এলাকার আবাসিক হোটেল সানমুনে হাত বেঁধে মাথা ও পায়ে ছুরিকাঘাত করে সাইফ উদ্দিন আহমেদ (৪৫) নামের এক আওয়ামী লীগ নেতাকে হত্যা করেছে দূর্বৃত্তরা। সোমবার (২১ আগস্ট) সকালে হোটেলের ২০৮ নাম্বার কক্ষে মিলে তার মরদেহ। পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে নিয়ে যায়। এ ঘটনায় ৫জনকে জিঙ্গেসবাদ করেছে পুলিশ।
হোটেলের সিসিটিভি ক্যামরায় দেখা যায়, রবিবার বিকেল সাড়ে চারটার দিকে অজ্ঞাত পরিচয়ে এক যুবকের সাথে হোটেল সানমুনে উঠেন আওয়ামী লীগ নেতা সাইফুদ্দিন। রাত ৮টার দিকে ওই যুবক হোটেলের কক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবে বেরিয়ে নিচে নেমে নিহত সাইফুদ্দিনের বাইকটি নিয়ে চলে যাওয়ার দশ্য সিসিটিভি ফুটেজে ধরা পড়ে। যা ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। এরপর থেকে নিহতের সাথে হোটেল কক্ষে যাওয়া যুবক লাপাত্তা রয়েছেন। হোটেল কক্ষে মরদেহ পাওয়া গেলেও নিহতের ব্যবহৃত মুঠোফোন, মানিব্যাগ ও মোটর সাইকেলটির সন্ধান পায়নি পুলিশ।
এদিকে, উদীয়মান আওয়ামীলীগ নেতাকে হত্যার বিচারের দাবীতে কক্সবাজার শহরে বিক্ষোভ করেছে তার রাজনৈতিক সহযোদ্ধারা।
নিহত সাইফ উদ্দিন কক্সবাজার পৌরসভার ৯নং ওয়ার্ডের দক্ষিণ ঘোনার পাড়ার সাবেক আনসার কমান্ডার আবুল বশরের ছেলে। তিনি এলাকার কাদেদিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ছিলেন। এছাড়া তিনি কক্সবাজার পৌর আওয়ামী লীগের গত কমিটির তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং কক্সবাজার জেলা ছাত্রলীগের সদস্য ছিলেন। তিনি তিন ছেলে সন্তানের জনক।
হোটেল সূত্র জানায়, রবিবার বিকেল ৫টায় সাইফউদ্দিন ও সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরিহিত আনুমানিক ৩০ বছর বয়সী এক যুবক হোটেলের ২০৮ নম্বর কক্ষ ভাড়া নেয়। রাতেই হোটেল থেকে বেরিয়ে সাইফ উদ্দিনের মোটর সাইকেল নিয়ে চলে যান ওই যুবক।
ছবি-হোটেলে যাওয়ার পর যুবকের সাথে কথা বলছেন নিহত সাইফুদ্দিন।
সোমবার সকালে নিহতের আরেক বন্ধু বৈরাম মোহাম্মদ ইলিয়াছ তাকে হোটেলে খুঁজতে আসেন। তাকে নিয়ে হোটেল ম্যানেজার সাইফউদ্দিনের ভাড়া নেয়া কক্ষে গিয়ে হুক বিহীন দরজা আটকানো দেখতে পায়। দরজা ঠেলে রক্তাত মরদেহটি দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেয় হোটেল কর্তৃপক্ষ।
হোটেল ম্যানেজার রেজাউল বলেন, নিহত সাইফ উদ্দিন ও তার বন্ধুরা প্রায়-ই সময় এ হোটেলে কক্ষ ভাড়া নিতেন। এই কারণে সাইফ উদ্দিন হোটেলের সকলের পরিচিত। কাজেই রবিবার যখন তিনিসহ আরেকজন মাস্ক পরিহিত যুবক কক্ষ ভাড়া নিতে আসেন তখন আমরা শুধু নিহতের নামই খাতায় নথিভুক্ত করি।
তিনি আরো বলেন, রবিবার কক্ষ ভাড়া নেয়ার কয়েকঘন্টা পরেই সাইফ উদ্দিনের সাথে আসা অপরজন অর্ধভেজা পাঞ্জাবি পরিহিত অবস্থায় হোটেল থেকে বের হন। তিনি যাওয়ার সময় সাইফ উদ্দিনের মোটর সাইকেল নিয়ে গেছেন। যার ফুটেজ আমাদের সিসিটিভিতে সংরক্ষিত আছে।
নিহত সাইফ উদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে পরিচিত শহরের কলাতলীর বৈরাম মোহাম্মদ ইলিয়াছ বলেন, আমরা (সাইফুদ্দিনসহ) প্রতিদিন বিকেলে হাটতে বের হয়। কিন্তু রবিবার তার (সাইফ উদ্দিনের) সাথে আমার দেখা হয়নি। রাতে সাইফ উদ্দিনের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়ায় নিহতের স্ত্রী আমার সাথে যোগাযোগ করেন। পরে আমি রাতে বিভিন্ন জায়গায় খবর নেই। সকাল বেলা সানমুন হোটেল আসি। এখানে এসে তার রক্তাত মরদেহ দেখতে পায়।
নিহতের আরেক বন্ধু কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের ব্যক্তিগত সহকারি মোহাম্মদ আলী ছোটন বলেন, সাইফের মৃতদেহ উদ্ধারের পর আমরা হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ দেখি। সেই ফুটেজে সাইফের সাথে যাকে দেখা গেছে তার শারিরীক গঠন নিহতের দূর সম্পর্কের শ্যালক কায়সার হামিদ নয়নের মতো লাগছে।
ছবি-জেলা আওয়ামী লীগের সাধরণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে কক্সবাজার শহরের প্রধান সড়কে মিছিল।
তিনি আরো বলেন, আওয়ামীলীগ নেতার মরদেহ উদ্ধারের পর নয়ন ফেসবুকে হত্যাকারীর বিচার চেয়ে পোষ্ট করলেও তাকে আমরা কয়েক দফা কল করে ঘটনাস্থলে ডেকেছিলাম। কিন্তু তিনি আসেননি। পরে শুনেছি পুলিশ তাকে হেফাজতে নিয়েছে।
অপরদিকে, নিহতের শ্যালক হিসেবে পরিচিত কায়সার হামিদ মানিককে ঘিরে সন্দেহ তৈরি হলে তার ছবিসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেন সংক্ষুদ্ধরা।
এ অবস্থায় সোমবার বিকাল ৪টার দিকে ইংরেজিতে ‘কেএইচ নয়ন’ নামে ফেসবুক একাউন্ট থেকে লিখেন-‘আমি নয়ন, নিজেও একজন আইন বিভাগের ছাত্র। আইনের একজন ছাত্র হিসেবে আমি শিখেছি, আদালত থাকতে আমি আইন কখনো নিজের হাতে তুলে নিব না। ঘটনার আসল রহস্য উৎঘাটন করা হওক এবং সিসি টিভি ফুটেজ ভালো করে দেখেন সবাই কি মিল আছে আমার সাথে। আমি এই হত্যাকান্ড বা এই ঘটনায় কোন ভাবে সম্পৃক্ত নই। আমি হত্যাকান্ডে জড়িত থাকলে আমি নিজেই আমার সাজা প্রার্থনা করছি। আর যারা আসল বিষয়টাকে ঢাকার জন্য মিথ্যে নিউজ প্রচার করছে তাদের কাছে অনুরোধ চোখ থাকতেও অন্ধ না হয়ে আরেকটু ভালো করে দেখুন ফুটেজ টা। এই মুহূর্তে এর চেয়ে বেশী কিছু বলার মত মানসিক শক্তি আমি হারিয়ে ফেলেছি।
বিকেল ৫টা ৪ মিনিটে কায়সার হামিদ নয়নের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জারে প্রতিবেদকের কথা হয়। তখন তিনি সদর থানায় অবস্থান করছেন জানিয়ে বলেন, আমি আনসার ভিডিপির ২১ দিনের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছি। সকাল হতে বিকেল ৫টা চলা প্রশিক্ষণে সোমবার সকালে অংশ নিই। হঠাৎ এক সহপাঠির মাধ্যমে সাইফউদ্দিন ভাই খুন হবার বিষয়টি জানার পর ছুটি নিয়ে ঘটনাস্থলে যায়। সিসিটিভিতে দেখা যুবক আমার মতো বলে প্রচার পাবার পর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ আমাকে ডাকলে আমি থানায় এসেছি। আমার সাথে আরো কয়েকজনকে ডাকা হয়েছে। কেউ কেউ চলে গেলেও আমি এবং সাইফু ভাইয়ের বন্ধু ইলিয়াছ এখনো থানা থেকে বের হতে পারিনি।
নিহতের ছোট ভাই মহিউদ্দিন বলেন, আমার বড় ভাইয়ের মৃতদেহ বিছানায় পড়ে থাকলেও তার সাথে হোটেলে উঠা নয়নের কোন খবর নেই। এছাড়া আমার ভাইয়ের মোবাইল, মোটরসাইকেলের সন্ধান পাইনি এখনো।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ স্বজনদের হস্তান্তর করা হয়েছে। কাউকে হেফাজতে নেয়া হয়েছে কি না তা বলার সময় এখনো হয়নি। ঘটনার সাথ কে বা কারা জড়িত, কেন এই হত্যাকান্ড এসব জানতে পুলিশ কাজ করছে। সব আয়ত্বে নিয়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে সবকিছু জানানো হবে।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, নিহতের প্যান্টের বেল্ট দিয়ে হাত দুইটি বাঁধা ছিল। তার শরীরে তিনটি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন রয়েছে। হোটেলের সিসিটিভির ফুটেজ দেখে সাথে থাকাদের শনাক্ত করতে কাজ করতে পুলিশ। আশা করছি খুব শিগগিরই এ হত্যার রহস্য উম্মোচন করতে পারব।
এদিকে, সাইফ উদ্দিনের খুনিদের দ্রুত গ্রেপ্তারের দাবিতে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেছে দলটি ও তার অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
উল্লেখ্য, রবিবার দুপুরে নিজের ফেইসবুক আইডিতে নিহত সাইফুদ্দিন লিখেছেন, ‘বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের আমলে হয়রানিমূলক মিথ্যা মামলায় তিন বছর কারাভোগের পরও প্রায় ২৪ বছর ঐ মামলায় হাজিরা দিয়ে আসছি। অথচ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ১৫ বছর। তারপরেও শান্তি নেই। আর কত বছর হয়রানির শিকার হতে হবে আল্লাহ জানে। এ সময় তৎকালিন ছাত্রলীগ নেতা শফিউল্লাহ আনসারি, নাসির উদ্দিন ও কফিল উদ্দিন ছিলেন।
মন্তব্য করুন