বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৪১ অপরাহ্ন
সাজ্জাদুল করিম।
দুই হাজার সালের শুরুর দিকে আইন পেশায় আমি যুক্ত হয়। তবে আইন পেশা কখনো আমার অগ্রাধিকারে ছিল না। অনেকটা ভাগ্যের পরিহাসে আমি এ পেশাতে সম্পৃক্ত হয়। আমার প্রথম চয়েস ছিল বিচারক হওয়া। বিচারকের জীবনে অর্থ কম,সম্মান বেশি। আবার আইনজীবীর ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পুর্ণ বিপরীত। আইন পেশায় সম্মান কম,কিন্তু অর্থ বেশি। কিন্তু বিধাতা হয়ত আমার জন্য দ্বিতীয়টি ভেবে রেখেছিলেন।
অতীতে আইন পেশা ছিল বেশ সমৃদ্ধ,গৌরবময়,মহান এক পেশা। নিকট অতীতেও অনেক খ্যাতিমান, তারকা আইনজ্ঞ এ পেশায় যুক্ত ছিলেন। একসময় টেকনাফের সাবেক জাতীয় পরিষদ সদস্য এড্ নুর আহমদ সাহেব,সাবেক মহকুমা গভর্নর এড্ জহিরুল ইসলাম,ইসলামী আন্দোলনের প্রবাদপ্রতীম ব্যক্তিত্ব এড্ ছালামত উল্লাহ সাহেব, খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ ও আইনজ্ঞ প্রফেসর নুর আহমদ সাহেব, প্রখ্যাত আইনজীবি শামসুল আলম কুতুবী, আমার মামা স্বনামধন্য প্রাক্তন পাবলিক প্রসিকিউটর,বহু আইন গ্রন্হের প্রণেতা জাহাঙ্গীর সাহেব আইন পেশায় খ্যাতির মধ্য গগনে ছিলেন।
প্রথমোক্ত তিনজন এখন পরপারে। চতুর্থজন প্রফেসর সাহেব আজ বয়সের ভারে ন্যুজ। ব্যস্ত আইনজীবী হয়েও শামসুল আলম সাহেব বর্তমানে আইন পেশার চেয়ে ধর্মকর্ম নিয়ে বেশি ব্যস্ত। এখন কেবল প্রাক্তন পিপি মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর সাহেবই শীর্ষ আইনজীবী হিসাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। তারও আগে জনাব ফিরোজ মিয়া,বাবু জ্যোতিশ্বর চক্রবর্তী, জনাব আবু আহমদ,মওদূদ উকিল, মোহাং আলী উকিল প্রমুখ আইনজীবীগন আইন পেশাকে আলোকিত করেছেন।
পেশার প্রথম পর্যায়ে একজন আইনজীবী পরিচয়ে আমার কোন নেতিবাচক ধারনা ছিল না। কালক্রমে আইন পেশার মান ক্রমশ নিম্নমুখী হতে থাকে। অনেক সমাজবিরোধী, মাফিয়া, মামলার আসামী আইন পেশায় প্রবেশ করেন। যার অনিবার্য পরিণতিতে আইন পেশা আজ প্রশ্নবিদ্ধ।
অতীতে রাজনৈতিক কারন ছাড়া কোন আইনজীবী জেলে যায় নি। আইনজীবীগনও আইন যাতে ভঙ্গ না হয়,এমন বিষয়ে সচেতন, সতর্ক থাকতেন। ফলে আইনজীবীদের সবাই সমীহ করতেন। হালে কতিপয় আইনজীবী এসবের ধারে নেই। অনিবার্য কারনে প্রতারনা,জালিয়াতি, চাঁদাবাজীর মত অপরাধে বেশ কয়েকজন আইনজীবীকে জেলে যেতে হয়েছে। এতে চরমভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে আইনজীবী সমাজের ভাবমূর্তি।
আইন পেশার অধঃপতনের ক্ষেত্রে বার কাউন্সিলের ভুমিকাও কম নয়। আইন পেশাটিকে বার কাউন্সিল একেবারে সস্তা করে দিয়েছেন। যে কেউ চাইলে আইন পেশায় আসতে পারে। এলএলবি পাসের ন্যুনতম মানদণ্ড নেই। নেই পরীক্ষা ব্যবস্হাপনার উপযুক্ত তদারকি। রাজনৈতিক মামলা ছাড়া একাধিক মামলার আসামী হলে আইন পেশায় নিষিদ্ধ করা দরকার। পরীক্ষার সবক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিভাগ ছাড়া আইনজীবী নিবন্ধন বন্ধ রাখতে হবে। আইন পেশার প্রবেশের ক্ষেত্রে ন্যুনতম বয়সসীমা উল্লেখ থাকতে হবে। কিন্তু বার কাউন্সিল কোনকিছুই করবে না। তাদের কাজ কেবল ভোটার বৃদ্ধি করা।
প্রায় দুই যুগের কাছাকাছি আইন পেশায় রয়েছি। কিন্তু কোনদিন কোন বিচারকের খাসকামরায় যায়নি। জিআর শাখা, কোর্ট হাজতঘরও কখনো আমি স্বচক্ষে দেখিনি। আদালত ভবনের সন্নিকটে বিশাল চত্বর জুড়ে রয়েছে কক্সবাজার সদর থানা। বহুল-আলোচিত সেই থানার ভিতরে যাওয়ার সৌভাগ্যও হয়নি কখনো। থানা কেবল দুর হতেই অবলোকন করেছি। অনেকটা দুধের সাধ ঘোলে মেটানোর মত।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এলএলবি(অনার্স)এর প্রথম বাচের আমি এক বিবর্ণ প্রাক্তন ছাত্র। একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার তিনজন ব্যাচমেট জেলাজজ পদমর্যাদায় এই আদালত পাড়ায়ই রয়েছেন। ঐ সমস্ত কোর্টের অসংখ্য মামলা প্রতিদিন আমার নিকট আসে। কিন্তু একটি দিনের জন্যও আমি সেই কোর্ট গুলিতে যায়নি। যদিও সততা, দক্ষতা,মানবিকতায় আমার তিন ব্যাচমেটই বাংলাদেশ বিচার বিভাগের রতœ ও অহংকার।
এসব কারনে আদালতে সবচেয়ে বেশি মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবীর একজন হয়েও আমি গরীব। এই শহরে আমার নিজের নেই কোন বাড়ি। নেই গাড়ি। টেকপাড়ায় আমার মরহুম বাবার একটি আটপৌরে টিনসেড বাড়ি আছে। যেখানে আমি বড় হয়েছি। সেই স্মৃতিধন্য বাড়িটিও আমাকে বিত্তশালী মনে করে আমার অন্য আত্মীয়রা করতলগত করে রেখেছেন।
পেশায় নবাগত কিংবা মধ্যমমানের অনেক আইনজীবীরও বাড়ি,অর্থবিত্ত রয়েছে। একটু সিনিয়রদের রয়েছে বহুতল ভবন,গাড়ি। প্রচুর অর্থ,বাড়ি,গাড়ি না থাকলেও আমার কোন অনুশোচনা নেই। নেই কোন অনুযোগ। আমার আল্লাহ আমাকে যা দিয়েছেন,অনেকের তাও নেই। বিখ্যাত কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের ভাষায়,
পরের অভাব মনে করিলে চিন্তন।
আপন অভাব ক্ষোভ রহে কতক্ষণ?
লেখক-সাজ্জাদুল করিম, সিনিয়র আইনজীবী কক্সবাজার জেলা আইনজীবী সমিতি।
মন্তব্য করুন