বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন

ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাত মাসে আক্রান্ত ২১৩৪ জন

ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সাত মাসে আক্রান্ত ২১৩৪ জন

অনলাইন বিজ্ঞাপন

ফাইল ছবি।

 

 

সায়ীদ আলমগীর।।

কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়েই চলেছে। ছড়িয়ে পড়ছে জেলা সদর ও উপজেলায়ও। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত কক্সবাজারে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে দুই হাজার ১৩৪ জন। এর মাঝে রোহিঙ্গার জনগোষ্ঠীর সংখ্যা এক হাজার ৯৫৮ জন। শতকরা হিসাবে এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের প্রায় ৯২ ভাগ।

এ ছয় মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এরপরও ডেঙ্গুর প্রকোপ গত বছরের তুলনায় নিম্নমুখী বলে দাবি কক্সবাজার সিভিল সার্জন কার্যালয়ের।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দুই হাজার সাতজন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৯০৫ জন রোহিঙ্গা ও ১০২ জন ক্যাম্প সংলগ্ন স্থানীয় বাসিন্দা। এর বাইরে কক্সবাজার সদর হাসপাতালসহ আটটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১২৭ ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে স্থানীয় ৭৪ এবং ৫৩ জন রোহিঙ্গা। ঘনবসতি ও অপরিচ্ছন্নতায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া দুরূহ।

সর্বশেষ ২৩ জুন একজনের মৃত্যু নিয়ে বিগত ছয় মাসে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। তাদের সবাই রোহিঙ্গা। আক্রান্ত বিবেচনায় ৫৭ শতাংশ পুরুষ ও ৪৩ শতাংশ নারী। এতে ০-৫ বছরের মধ্যে ৬ শতাংশ, ৬-১৮ বছরের মধ্যে ২১ শতাংশ, ১৯-৪০ বছরের মধ্যে ৬১ শতাংশ, ৪১-৬০ বছরের মধ্যে ১১ শতাংশ ও ৬০ বছরের ঊর্ধ্বে ১ শতাংশ পাওয়া গেছে।

সিভিল সার্জন অফিসের পরিসংখ্যানবিদ পংকজ পাল জানান, এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা গত বছরের তুলনায় নিম্নমুখী বলা যায়। ২০২২ সালে কক্সবাজারে মোট ১৯ হাজার ২৩১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। যার মধ্যে ১৫ হাজার ৬৩৬ জন রোহিঙ্গা ও ৩ হাজার ৫৮৫ জন স্থানীয় ছিলেন। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৩৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। যার মধ্যে রোহিঙ্গা ২৬ জন ও স্থানীয় ১৩ জন।

এ অবস্থায় আরও দুই মাস পর্যালোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ দুই মাসের পরিসংখ্যান নিলে বোঝা যাবে জেলায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি কোন দিকে যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, সাধারণত জুন-জুলাইয়ে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে এবং অক্টোবরে কমে। তবে গত বছরের তুলনায় এ বছর অনেক আগেই ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিয়েছে।

স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তৎপর। তবে রোহিঙ্গাদের মতে, ঘনবসতি ও অপরিচ্ছন্নতায় মশার উপদ্রব বেড়েছে। এ পরিস্থিতিতে ক্যাম্পে ডেঙ্গু থেকে রক্ষা পাওয়া দুরূহ।

বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মৌসুমি বৃষ্টিপাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে। চলতি বছর যে হারে ডেঙ্গু আক্রান্তের ঘটনা ঘটছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ঘাটতি ও ঘনবসতির কারণে সেখানে সংক্রমণের হার ক্যাম্পের বাইরের এলাকার তুলনায় অনেক।

কক্সবাজারের ৩৩টি ক্যাম্পের মধ্যে উখিয়ার চারটি ক্যাম্পে ডেঙ্গু আক্রান্তের হার বেশি। সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রাথমিক গবেষণা মতে, পুরোনো খাল ও জলাশয়ের কারণে এসব ক্যাম্পে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি।

সরেজমিনে দেখা যায়, কুতুপালং লম্বাশিয়া, বালুখালীর তাজনিমারখোলা, ময়নারঘোনাসহ আশপাশ এবং টেকনাফের জাদিমুড়া, শালবন ও লেদা রোহিঙ্গা ক্যাম্পের অধিকাংশ ড্রেন থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। এসব ড্রেনের পাশে বসে সময় কাটায় রোহিঙ্গা শিশুরা। ক্যাম্পের পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা মাঝে মাঝে ড্রেন পরিষ্কার করে।

কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নেতা হোসাইন আহমদ বলেন, ক্যাম্পে এত ঘনবসতি যে এখানে ডেঙ্গু থেকে বাঁচার উপায় নেই। জনসংখ্যা অনুযায়ী শিবিরগুলোতে পর্যাপ্ত টয়লেট নেই। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়েও ক্যাম্পগুলো অনেক পিছিয়ে।

ক্যাম্পে কাজ করা একটি সংস্থার ওয়াশ সেক্টর সমন্বয়কারী সাদেক মোস্তফা বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ড্রেন, আবর্জনা ফেলার ডোবা এবং স্থির জলের পয়েন্টগুলো পরিষ্কার রাখা হচ্ছে।

টেকনাফের শালবন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দা কালাম হোসেন বলেন, ড্রেন অপরিষ্কার থাকায় ক্যাম্পে আগের তুলনায় মশা বেড়েছে। অন্যদিকে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে দিন দিন। বেশি আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। কারণ তারা ড্রেনের পাশে বসে খেলাধুলা করে সময় কাটায়।

বালুখালী তাজনিমারখোলা ক্যাম্পে বাস করা নূরজাহান বলেন, আমার ঘরে পাঁচটি শিশু আছে। মঙ্গলবার থেকে তাদের দুজনের প্রচণ্ড জ্বর। প্রাথমিক চিকিৎসার পরও অবস্থার উন্নতি হয়নি। ধারণা করছি, হয়তো তারা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে। গত বছর আমার পরিবারের দুই সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিল।

কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার কার্যালয়ের প্রধান স্বাস্থ্য সমন্বয়ক ডা. আবু তোহা ভূঁইয়া জানান, ডেঙ্গু প্রতিরোধে ক্যাম্পগুলোতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত বিতরণ করা হয়েছে সাড়ে তিন লাখ মশারি। পাশাপাশি ক্যাম্পে ডেঙ্গু রোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাসহ বিভিন্ন প্রচারণা চালানো হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। বিশেষ করে ৩ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গুর বিস্তার বেশি।

কক্সবাজার সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক (সুপার) ডা. মোমিনুর রহমান জানান, জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। বুধবার (১২ জুলাই) ১৬ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি রয়েছে। এদের মাঝে সাতজন মঙ্গলবার ভর্তি হয়েছে। সাত জনের মধ্যে দুজন রোহিঙ্গা। ১৬ জনের মধ্যে ৫ জন রোহিঙ্গা ভর্তি রয়েছেন। চলতি মাসের ১২ দিনে ৪৯ জন ডেঙ্গুরোগী চিকিৎসা নিয়েছেন। গত জানুয়ারিতে ২৫ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১২ জন, মার্চে ৬ জন, এপ্রিলে ৪ জন, মে মাসে ৯ জন এবং জুনে ২৮ জন ডেঙ্গুরোগী সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখানে মৃত্যুর ঘটনা নেই।

কক্সবাজারের সিভিল সার্জন বিপাশ খিসা জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। এ পর্যন্ত জেলায় যত ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে এর মাঝে ৯২ শতাংশ রোহিঙ্গা। প্রতিদিন উপজেলায়ও ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হচ্ছে বলে তথ্য পাচ্ছি। সম্ভাব্য ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলো। একইসঙ্গে সচেতনতা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশেষ করে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও তার আশপাশের এলাকা পরিচ্ছন্ন রাখা, জমানো পানি থাকলে তা পরিষ্কার করার কাজ চলছে।

গত তিন সপ্তাহে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়েছে। চলতি বছরের জুন মাসের শুরুর দিকে (৯ জুন পর্যন্ত) দেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৮৬৫ জন এবং মৃতের সংখ্যা ছিল ২১ জন। এক মাসের ব্যবধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী সোমবার (১০ জুলাই) আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ১৯৩ জনে এবং মৃতের সংখ্যা ৫৬। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে রোহিঙ্গাদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয় না।

সূত্র-জাগোনিউজ


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
Desing & Developed BY MONTAKIM