বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৩৫ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি-রামুর লম্বরীপাড়া বাঁকখালী নদীতে ডুবে নিহত জোহরা (৯) ও মাওয়া (৫)।
ওয়াহিদ রুবল।।
সাবেকুন্নাহার (৩২)। কক্সবাজার রামুর ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের খোন্দকার পাড়ার বাসিন্দা আব্দুল করিমের স্ত্রী। ২০২২ সালে ২২ এপ্রিল বেলা ১১ টায় ইউনিয়নের লম্বরীপাড়া বাঁকখালী নদীতে ডুবে দুই শিশুকন্যা জোহরা (৯) এবং মাওয়া (৫)কে হারিয়েছেন তারা। দুই কন্যার মৃত্যু কথা মনে করে নিরবে কাদেন ছকিনা।
তিনি বলেন, ঐ সময় আমি রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলাম। আমার অসাবধানতার জন্য আমার শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারছিনা। বর্তমানে নিজ বাড়ি ছেড়ে তারা ভারুয়াখালীতে বসবাস করে যাচ্ছেন। ছকিনা বলেন, বাড়িতে ঢুকলেই মেয়েদের ছবি ভেসে উঠে। আমি অস্থির হয়ে পড়ি। তাই বাবার বাড়িতে থাকি। মাঝে মাঝে স্বামীর বাড়িতে যায়।
এভাবে সন্তান হারানোর আবেগের কথা জানালেন গেল রবিবার (২৮ মে) টেকনাফ হ্নীলাইবনে আব্বাস (র:) আল ইসলামিয়া হেফজ খানা ও এতিমখানার নুরানী মাদ্রাসার শিশু সাকিবুল ইসলাম (৬) এর নানা মকবুল হোসেন। তারা বলেন স্বজন হারানোর বেদনা তারাই বুঝে যারা হারিয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গেল এক বছরে কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায় পানিতে ডুবে প্রাণ হারিয়েছেন ১০০ জনেরও বেশি মানুষ। নিহতদের অধিকাংশই শিশু। পুকুরে ডুবে শিশু মৃত্যুর তালিকায় শীর্ষে রয়েছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়া। এ ছাড়া মহেশখালী দ্বিতীয় ও সদর উপজেলার অবস্থান তৃতীয়। এ তথ্য উঠে এসেছে কক্সবাজারে পানিতে ডুবে মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানে জরিপের কাজ করা গণমাধ্যম উন্নয়ন ও যোগাযোগ বিষয় প্রতিষ্ঠান ‘সমষ্টি’। তাদের জরিপ বলছে ২০২২ সালে থেকে ২০২৩ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১০১ জনের পানিতে ডুবে মারা গেছেন। এর মধ্যে ৫৬ শিশু। আর গত ৩ বছরে পুকুরের পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ১৯১ জনের। সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে কুতুবদিয়া উপজেলায়। যদিও তাদের তথ্যগুলো পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের উপর তৈরি করা। বাস্তবে এ সংখ্যা আরো বেশি বলে মনে করেন স্থানীয়রা। এ অবস্থায় পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার কমাতে শিশুদের সাঁতার শেখানোর কার্যক্রম চালুর দাবি তুলেছেন সচেতন মহল।
সমষ্টি’র গবেষণা পরিচালক রেজাউল হক বলেন, গনমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে আমরা তথ্য সংগ্রহ করে থাকি। গণমাধ্যমে প্রকাশ পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর ঘটে সকালে ৮টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে । যাদের বয়স শুণ্য থেকে ৫ বছর। এ সময়ে মায়েরা গৃহস্থলী কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন, বাবারা কাজের জন্য ঘরের বাইরে যায়। দরিদ্র ও গরিব পরিবারে এ মৃত্যুহার বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, কুতুবদিয়া উপজেলার কমবেশি প্রায় সব বাড়িতে পুকুর রয়েছে। এসব পুকুরে নেই ঘেরা-বেড়া। পিতামাতার অসাবধানতার কারণে শিশুরা পানি ডুবে মারা যাচ্ছে। এছাড়া প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা সম্পর্কেও নেই কোন ধারণা। ফলে মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। অভিভাবকদের সচেতনতা আর সাঁতার শেখানোর মাধ্য এ মৃত্যু কমানো সম্ভব বলে দাবি তাদের।
অভিযোগ উঠেছে সরকারিভাবে সাঁতার শেখানোর প্রকল্প থাকলেও মাঠ পর্যায়ে এর কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনা।
বিষয়টি স্বীকার করে কুতুবদিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপংকর তঞ্চঙ্গ্যা বলেন, একবছর বা তিন বছরে কত শিশু মৃুত্য হয়েছে তার কোন হিসেব আমাদের কাছে নেই। শোনেছি জাতীয় পর্যায়ে একটি সাঁতার শেখানো প্রকল্প আছে। কিন্তু কুতুবদিয়ায় এর কোন কার্যক্রম নেই। আমরা তাদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। তবে অভিভাবকের সচেতনতা ছাড়া মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব না।
কুতুবদিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা নাদিম বলেন, কুতুবদিয়ায় পুকুরে ডুবে এক বছরে প্রায় ৫০ জনের অধিক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। পিতা-মাতার উদাসিনতা এবং পুকুরে ডুবে যাওয়াদের প্রাথমিক সেবার বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে।
জাতীয় পর্যায়ে ওয়াটার সেফটি’ নিয়ে কাজ করা ‘সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন এন্ড রিচার্জ বাংলাদেশের (সিআইপিআরবি) ম্যানেজার মো: সাফকাত হোসাইন বলেন, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু কমানো যায় সেজন্য আমরা কাজ করছি। এ পর্যন্ত কক্সবাজার সদর, উখিয়া এবং টেকনাফে ৪৫০০ হাজার শিশুকে সাতার শেখানো হয়েছে। একই সাথে পানিতে পড়া শিশুদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে ২০০ জনকে ভলেন্টিয়ারকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে সচেতনতামূলক সেমিনারও করা হচ্ছে। তবে পানিতে ডুবে কতজন শিশুর মৃত্যু হয়েছে তার সঠিক কোন তথ্য জানাতে পারেননি তিনি।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনচুর আলী চৌধুরী বলেন, প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের সাঁতার শেখানোর কোন নির্দেশনা সরকারিভাবে নেই।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. আবু সুফিয়ান বলেন, কক্সবাজারে কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা শিশুদের সাঁতার শেখানোর কাজ করছে। তবে পরিবারের পিতা-মাতার সচেতনতা ছাড়া পুকুরে ডুবে মৃত্যু এড়ানো সম্ভব না। পানিতে ডুবে মৃত্যুরোধে করণীয় ঠিক করতে উদ্যোগ নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
মন্তব্য করুন