শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন
ছবি-সেন্টমার্টিন হাসপাতাল।
ওয়াহিদ রুবেল, সেন্টমার্টিন থেকে ফিরে>>
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সামনেই বহুতল ভবনের একটি ২০ শয্যা হাসপাতাল। প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে গিয়ে দেখা যায় হাসপাতালের রিসিপশন থেকে শুরু করে জরুরি বিভাগ, বহি:বিভাগ, ল্যাব, এক্স-রে, ইসিজি, কর্তব্যরত ডক্টরস রুম, মহিলা ওয়ার্ড ও পুরুষ ওয়ার্ডসহ সব রুমে তালা ঝুলানো। বুঝার উপায় নেই এটি একটি চলমান হাসপাতাল। স্থানীয়রা জানিয়েছেন উদ্বোধনের পর থেকে হাসাপাতালে চিকিৎসক মাঝে মধ্যে আসেন। ফলে দ্বীপের মানুষগুলো সেবা বঞ্চিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে কর্তপক্ষ বলছে ২০ শয্যার হাসপাতালটি কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ। তবে, সম্প্রতি আন্তর্জাতিক চিকিৎসা সেবা সংস্থা সেভ দ্যা সিল্ড্রেন গর্ভবতী মা ও শিশুদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে হাসপাতালে।
তথ্য মতে, সেন্টমার্টিনে ইউনিয়নে বর্তমানে প্রায় ১৩ হাজার লোক বসবাস করে। তাদের সাথে প্রতি বছর যোগ হয় সাত থেকে আট লাখ পর্যটক। জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি মাথায় নিয়ে সরকার ২০০৮ সালে ৯ ফেব্রুয়ারি ১০ শয্যার একটি সরকারি হাসপাতাল উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এটি ২০ শয্যা হাসপাতালে উন্নতি করা হয়েছে। ১০ থেকে ২০ শয্যা হাসপাতালে উন্নতি হলেও নেই কোন সেবা কার্যক্রম। অথচ শুরুতে দুইজন চিকিৎসক, ছয়জন নার্স, দুজন ল্যাবরেটরি টেকনিশিয়ান, দুজন ফার্মাসিস্ট, ছয়জন ওয়ার্ডবয়, চারজন এমএলএসএস, তিনজন আয়া, একজন পিয়ন, একজন স্টোরকিপার, চারজন ঝাড়ুদার নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু কয়েক দিনের মাথায় নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা কর্মচারি হাসপাতাল ছেড়ে চলে যান। এরপর শূন্য পদে কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। বর্তমানে দুইজন মেডিকেল অফিসার এবং একজন এমএলএসএস নিয়োগ দেয়া হলেও হাসপাতালে থাকেন না কোন মেডিকেল অফিসার। সেন্টমার্টিন থেকে নৌপথে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার দূরে টেকনাফ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসা সেবা নেয়া দ্বীপের মানুষের পক্ষে দুরূহ। বর্ষা মৌসুমে এ অবস্থা আরও চরম আকার ধারণ করে। নৌ-অ্যাম্বুলেন্স না থাকায় জটিল রোগে আক্রান্ত হলেই বিনা চিকিৎসায় মরতে হয়। এ অবস্থায় হাসপাতাল চালুর কোন বিকল্প নেই বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা।
ছবি-তালাবদ্ধ জরুরি বিভাগ।
স্থানীয় ইউপি সদস্য মুজিবুর রহমান বলেন, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন শুধু দেশের নয় বিশ্বের কাছেও পরিচিত। প্রতিবছর এখানে সাত থেকে আটক লাখ পর্যটক বেড়াতে আসেন। কিন্তু চিকিৎসক না থাকায় দ্বীপের বাসিন্দা এবং বেড়াতে আসা পর্যটকরা স্বাস্থ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। সেবাটা আমাদের জন্য সোহার হরিণ পাওয়ার মতো অবস্থা।
তবে ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সেবা সংস্থা সেভ দ্যা চিলড্রেন ‘মামনি’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছেন। যে প্রকল্পের মাধ্যমে মা ও শিশুদের সেবা দেয়া হচ্ছে।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, টেকনাফ উপজেলার স্বাস্থ্য কেন্দ্রের আওতাধীন সেন্টমার্টিন উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ২০ শয্যা বিশিষ্ট্য হাসপাতালে রুপান্তর করা হয়। বর্তমানে ডা: রিয়াদ মো: সাইদ চৌধুরী এবং ডা: নওশাদ আলম কানন নামে দুইজন মেডিকেল অফিসার রয়েছেন। তবে এ দুইজনকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রাখা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, কাগজে কলমে ২০ শয্যা হাসপাতাল হলেও বাস্তবে একটি হাসপাতাল চালুর যে জনবল নিয়োগ দেয়ার কথা তা দেয়নি সরকার। এছাড়া ইনডোর হাসপাতল পরিচালনার জন্য পর্যাপ্ত ঔষুধ সরবরাহ ও ভর্তি রোগীর খাবারের ফান্ডও নেই। নেই বেডসহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা। এছাড়া চিকিৎসক ও নার্সদের থাকার আবাসিক ভবনগুলো ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে, খাবার পানি এবং বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নেই। শুধুমাত্র জরুরী বিভাগ ও বির্হবিভাগ চালু রাখা হয়েছে। ফলে ভর্তি রেখে রোগী সেবা দেয়া হয়না সেখানে।
ছবি-ল্যাব ইনফরমেশন।
স্থানীয়দের অভিযোগ, সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা হাসপাতাল পরিদর্শনে আসার সময় হলে চিকিৎসকরা একদিন আগে সেন্টমার্টিনে আসেন। অন্য সময় তাদের খোঁজে পাওয়া যায়না।
সাদ্দাম হোসেন নামে স্থানীয় এক যুবক বলেন, সংশ্লিষ্টদের উদাসিনতার কারণে চিকিৎসকরা এখানে থাকতে চান না। চিকিৎসকরা মাঝে মধ্যে আসেন।
পর্যটক রুহুল আমিন বলেন, অসাবধানতাবসত পাথরে আমার মাথা কেটে যায়। হাসপাতালে গেলে কোন রকম প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিয়েছে। কিন্তু সেলাই করতে পারেনি। এখন টেকনাফ যাওয়া ছাড়া আর কোন উপায় নেই।
পর্যটন হোটেল ব্যবসায়ী হায়দার আলী বলেন, সেন্টমার্টিনে ২০ শয্যা হাসপাতাল আছে কিন্তু সেবা নেই। সেবা পেতে আপনাকে টেকনাফ যেতে হবে।
জানতে চাইলে হাসপাতালের নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক ডা: রিয়াদ মো: সাইদ চৌধুরী বলেন, আমরা চারজন চিকিৎসক রুটিন করে টেকনাফ হাসপাতাল থেকে গিয়ে সেবা দিয়ে আসছি।
তিনি বলেন, ২০ বেড হাসপাতাল হলেও এখানে সরকারের সাপোর্ট নেই। তবে আমরা ওপিডি চালু রাখি। রোগীদের প্রাথমিক সেবা দিয়ে কিছুক্ষণ অবজারভেশনে রেখে রেফার করি। ইনডোর হাসপাতালটি এখনো চালু হয়নি। এরপরও কোন তথ্য জানতে চাইলে স্যারের সাথে কথা বলতে পারেন।
টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা: মো: আবুল কাশেম সরকারি নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক সেন্টমার্টিনে থাকেন না বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তারা টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত আছেন। সেন্টমার্টিনে এনজিও সংস্থা কর্তৃক নিয়োগ পাওয়া চিকিৎসক সেবা দিচ্ছেন।
সেন্টমার্টিন হাসপাতালে কর্মরত সেভ দ্যা চিলড্রেন ‘মা ও শিশু স্বাস্থ্য প্রকল্প’ (মামনি) প্রকল্পের টেকনাফ উপজেলা কো-অর্ডিনার মো: মিলন আহমেদ বলেন, সালে আমরা পুরো সেন্টমার্টিন দ্বীপ ঘুরে এখানকার মানুষের সাথে কথা বলে একটি তথ্য তৈরি করি। আমরা দেখি যে এখানে মা ও শিশু মৃত্যুর একটি নির্মম ইতিহাস রয়েছে। যারা নৌকা নিয়ে উপজেলায় সেবা নিতে যাওয়ার পথে মাঝ সাগরে মৃত্যুবরণ করেছেন। এরপর থেকে আমরা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের কার্যক্রম শুরু করি। তখন থেকে এ পর্যন্ত ৯১ টি সফল ডেলিভারি হয়েছে।
কক্সবাজার সভিল সার্জন ডা: মো: মাহবুবুর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলেও ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য করুন