বৃহস্পতিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৭:০৬ অপরাহ্ন
ফাইল ছবি।
ওয়াহিদ রুবেল
চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম কোনারপাড়া জিরো পয়েন্টে রোহিঙ্গাদের সশস্ত্র সংগঠন আরসা এবং আরএসও এর মধ্যে সংঘর্ষের পর থেকে চরম অস্থির হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো। প্রতিদিন ঘটছে গোলাগুলি, খুন, অপহরণসহ নানা অপরাধের ঘটনা। গেল ৫ মাসে হত্যাকান্ডসহ ৩১ টি সংঘর্ষের ঘটনায় ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বশেষ মঙ্গলবার (২১ মার্চ) দুপুরে একদল দুর্বৃত্ত রোহিঙ্গা ক্যাম্প ১৩এ ব্লক-জি/৪ ঢুকে বেচা মিয়ার ছেলে রফিক (৩০)কে গুলি করে। এতে ঘটনাস্থলেই নিহত হন রফিক। দুর্বৃত্তের গুলিতে গুলিবিদ্ধ আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে মৃত্যুবরণ করেন মাহমুদ হাসানের ছেলে মো: রফিক (৩৪)। আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন আছেন মোহাম্মদ হোসনের ছেলে যুবক ইয়াসিন (২৮)।
সংঘর্ষের ঘটনায় নিহতের তথ্য নিশ্চিত করেছেন উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী।
সোমবার ঘটনার পরপরই ক্যাম্পে কর্মরত ৮ এপিবিএন এর মিডিয়া কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার মো: ফারুক আহমেদ বলেছেন, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর থেকে ক্যাম্পে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সাথে ক্যাম্পে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়িয়ে অপরাধীদের ধরতে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
পুলিশ ও রোহিঙ্গা ক্যাম্প সূত্র বলছে, গত পাঁচ মাসে ক্যাম্পগুলোতে ৩১টির বেশি সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনায় ৩২ রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ জন রোহিঙ্গা মাঝি, ৮জন আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসী। অন্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে মাদক, অস্ত্র ও সোনার চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মিয়ানমারের সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘আরাকান স্যালভেশন আর্মি (আরসা) ও আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন বাহিনী ও মাস্টার মুন্না বাহিনীসহ ক্ষুদ্র আরো একাধিক বাহিনী ক্যাম্পে হত্যাকান্ড ঘটাচ্ছেন বলে দাবি করেছেন রোহিঙ্গারা।
উখিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) শেখ মোহাম্মদ আলী বলেন, মঙ্গলবারের ঘটনাসহ গেল ৫ মাসে ক্যাম্পে দুষ্কৃতিকারিদের গুলিতে প্রায় ৩২ জনের অধিক রোহিঙ্গা খুন হয়েছেন। এসব ঘটনায় ১৮টি মামলা দায়েরের পাশাপাশি ৪৫ জনকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
তথ্য মতে, ২১ মার্চ (সোমবার) ক্যাম্প-১৩ জি/৪ ব্লকে দুর্বৃত্তের গুলিতে দুইজন নিহত হওয়ার আগে ১৮ মার্চ (শনিবার) রাতে উখিয়ার ক্যাম্প ১২ জি-৭ এলাকায় সশস্ত্র দুর্বৃত্তের গুলিতে রোহিঙ্গা হাফেজ মাহবুব (২৭) নিহত হন। তিনি ১৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ব্লক/ডি-৯ এর সৈয়দ আমিনের ছেলে। এছাড়াও ৮মার্চ কুতুপালং ২ নাম্বর ক্যাম্পে সকাল ৭টার দিকে ডাব্লিউ ব্লকে রোহিঙ্গা নেতা সৈয়দ হোসেন ওরফে কালা বদা (৩৭)কে গুলি করে হত্যা করে। তিনি ২ নম্বর ক্যাম্পের হেড মাঝি (নেতা) ছিলেন। ৭ মার্চ ক্যাম্প-৯ রাত ১টার দিকে রোহিঙ্গা নেতা নূর হাবি ওরফে ডা. ওয়াক্কাসকে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। ৩ মার্চ উখিয়ার ক্যাম্প-১৯ এলাকায় দুর্বৃত্তের গুলিতে খুন হন মুহাম্মদ রফিক (৩৫)। ২৫ ফেব্রুয়ারি ভোরে উখিয়ার ক্যাম্প-২০’র পাহাড়ি এলাকার ছরার কাছে মরদেহ মিলেছে মৌলভী সামসু আলম (৩৮)’র। তিনি ক্যাম্প-১৭ ব্লক-সি সাব এইচের মৃত মিয়া চাঁনের ছেলে। বুধবার ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে কুতুপালং ক্যাম্প-৫-এ আরসা ও আরএসওর মধ্যে কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন রোহিঙ্গা মাঝি (নেতা) সলিম উল্লাহ (৩৪)। একই দিন দুপুরে বালুখালী ক্যাম্প-৮ আরসা ও আরএসও সন্ত্রাসীদের মধ্যে গোলাগুলিতে দুই রোহিঙ্গা শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। উম্মে হাফসা নামের ১১ বছর বয়সী শিশুর কোমরে এবং আট বছর বয়সী আবুল ফয়েজের ডান পায়ে গুলি লাগে। এভাবে গত ৫ মাসে ৩২ জন হত্যার শিকার হয়েছেন।
ক্যাম্পের একের পর এক সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে আশ্রিত সাধারণ রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন স্থানীয় ও আশ্রয়শিবিরে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার কর্মীরাও। অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ের ঘটনায় সবসময় আতংকে থাকছে শিবিরের ভেতরে রোহিঙ্গা, বাইরে স্থানীয় লোকজন।
উখিয়ার বালুখালী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা নেতা মুহাম্মদ ইয়াকুব আলী বলেন, মূলত ইয়াবা ব্যবসা, ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে
মিয়ানমারের দুটি সশস্ত্র গোষ্ঠী এবং নবী হোসন গ্রুপ, মাস্টার মুন্না গ্রুপসহ বিভিন্ন গ্রুপ- উপগ্রুপের মধ্যে এসব হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে।
তিনি বলেন, আগে সন্ধ্যা হলেই ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যেত সন্ত্রাসীদের হাতে। এখন সন্ত্রাসীরা এতই বেপরোয়া যে যখন-তখন প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালাতে দ্বিধা করছেনা। এখন ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের দাপট চলছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক রোহিঙ্গা মাঝি বলেন, ক্যাম্পে মাদক চোরাচালানের অন্যতম হোতা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী নবী হোসেন। তার বাহিনীর কয়েক শ’ সদস্য ইয়াবা, আইস ও সোনার ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে। শুরুর দিকে আরসার সঙ্গে মিলেমিশে মাদক চোরাচালান করতেন। বর্তমানে আরসা থেকে বেরিয়ে মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ শুরু করে তিনি। দল ভারী করতে এখন নবী হোসেন কাছে টানেন আরএসওকে। আরএসও এবং নবী হোসেন বাহিনী মিলে ক্যাম্প থেকে আরসাকে উৎখাত করতে মরিয়া। আর আরসা সদস্যরা মরিয়া আরএসওকে ঠেকাতে। ফলে আধিপত্য বিস্তারে খুনোখুনি লেগেই আছে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিয়মিত গোলাগুলি ও খুনের ঘটনায় আতংক দেখা দিয়েছে স্থানীয়দের মাঝেও।
উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প অধ্যুষিত পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ক্যাম্পের ভেতরে ৩০-৩৫ হাজারের মতো দোকানপাট রয়েছে। অধিকাংশ দোকানপাটের মালিক রোহিঙ্গারা। সেখানেই চলে মাদকের বেচাবিক্রি। রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পের ভেতরে রাখা না গেলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড ও মাদক চোরাচালান নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবে সম্ভব নয়। মাদক নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে খুনের ঘটনাও কমবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্যাম্পের পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে হলে মাদক, অস্ত্র চোরাচালান রোধ এবং রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের গ্রেফতারে যৌথ অভিযান জরুরী।
সম্প্রতি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে আরসা ও নবী হোসেন বাহিনীর মধ্যে প্রায়ই মুখোমুখি সংঘর্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। আরসার উপস্থিতি ও তাদের সন্দেহজনক কার্যক্রমে নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ২০২১ সালে আশ্রয়শিবিরে ২২টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটলেও ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩১টিতে। ২০২১ সালে অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১৭৩টি। ২০২২ সালে ঘটেছে ৮৬টি।
১৪ এপিবিএন অধিনায়ক ও অতিরিক্ত উপমহাপরিদর্শক ছৈয়দ হারুনুর রশিদ বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মূলত সশস্ত্র গোষ্ঠীসহ কয়েকটি গ্রুপ খুনোখুনিতে জড়িয়ে ক্যাম্পে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি এবং সাঁড়াশি অভিযানের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার অভিযান চালাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, আগে রাতের বেলায় ক্যাম্পগুলোতে সন্ত্রাসীদের গোলাগুলি-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতো। এখন দিনদুপুরেও খুন-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে। বিষয়টি উদ্বেগজনক। শুধু রোহিঙ্গা নয়, আমরাও আতংকিত। আতংক নিয়েই কাজ করছে এনজিও-আইএনজিওর কর্মীরা।
তিনি বলেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিস্থিতি নিয়ে আমি সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছি। অনেকবার সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত জানিয়েছি। কিন্তু কোন সুফল পাচ্ছি না। এপিবিএন কাজ করছে কিন্তু অভিযুক্তদের ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন।
এ অবস্থায় ক্যাম্পগুলোতে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষায় সরকারের অন্যান্য বাহিনীসহ যৌথ অভিযান পরিচালনার মাধ্যমে অপরাধীদের ধরতে হবে।একই সাথে ক্যাম্পের চারদিকে দ্রুত কাঁটাতারের বেড়ার নির্মাণকাজ শেষ করে, সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের কার্যক্রম বৃদ্ধি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়াতে হবে।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে দায়িত্বে থাকা ৮-আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক (অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. আমীর জাফর বলেন, মাদক-চাঁদাবাজি, অপহরণসহ নানা অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পে কয়েকটি গ্রুপ কাজ করছে এপিবিএন। একই সাথে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে ।
মন্তব্য করুন