বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৭:৪৯ পূর্বাহ্ন
ফাইল ছবি- ৫ মার্চ রোহিঙ্গা ক্যাম্পে লাগা আগুন।
ওয়াহিদ রুবেল,
রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আধিপত্য বিস্তার করতে পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্যে প্রণোদিতভাবে আগুন লাগানো হয়। অগ্নিকান্ডে ২ হাজার ৮০৫টি শেল্টার পুড়ে ছাই হয়েছে। এতে ৩ হাজার ১১ পরিবারের ১৫ হাজার ৯২৬ রোহিঙ্গা গৃহহীন হয়ে পড়ে। নিহতের ঘটনা না ঘটলেও আহত হয়েছেন ২১২ রোহিঙ্গা। ক্যাম্পে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। একই সাথে ঘটনার অধিক তদন্ত করতে মামলা দায়েরসহ ১২টি সুপারিশ করে তদন্ত রিপোর্ট জেলা প্রশাসককে হস্তান্তর করা হয়েছে।
রবিবার (১২ মার্চ) বিকেলে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কমিটির সদস্যরা জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ শাহীন ইমরানের হাতে ৪ পৃষ্ঠার মূল রিপোর্টের সাথে ৭০ পৃষ্ঠার সাপোর্টিং ডকুমেন্টসসহ ৭৪ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট জমা দেন।
এরপরে জেলা প্রশাসনের শহীদ এটিএম জাফর আলম সম্মেলন কক্ষে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলেন তদন্ত কমিটি। এসময় তদন্ত কমিটির সদস্য ক্যাম্প ইনচার্জ, উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, এনএসআই কক্সবাজার’র উপপরিচালক, এপিবিএন’র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং ফায়ার সার্ভিসের উপ সহকারী পরিচালক উপস্থিত ছিলেন।
আরো পড়ুন-রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পরিকল্পিত আগুন; ভিডিও ভাইরাল
তদন্ত কমিটির প্রধান এডিএম মো. আবু সুফিয়ান বলেন, ৫মার্চ বিকেলের অগ্নিকান্ডের পর গঠিত সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি ৬মার্চ হতে তদন্ত কার্যক্রম শুরু করে। সরজমিন পরিদর্শন কালে ৭৫জনের সাক্ষাতকার ও লিখিত নেয়া হয়েছে। ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী রোহিঙ্গা, সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধি, জনপ্রতিনিধি এবং স্থানীয় লোকজনের কথা বলেছি। কথা বলেছি, ক্যাম্পে লারনিং সেন্টারের ইনস্ট্রাকটরসহ সংশ্লিষ্টদের সাথে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় প্রকাশিত ও প্রচারিত সংবাদ যাচাই ও তিনদিন অন দ্যা স্পট গিয়ে বিভিন্ন ভাবে ঘটনা বুঝার চেষ্টা করি। এক কথায় আমরা সব মহলের সাথে কথা বলে যাচাই-বাছাই করে আমরা নিশ্চিত হয় যে, আধিপত্য বিস্তার করতে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে আগুনটি লাগানো হয়েছে।
আবু সুফিয়ান আরো বলেন, বেলা আড়াইটার দিকে ১১নং ক্যাম্পের ডি ব্লকে আগুন দেয়া জ্বলে উঠে। এ সময়ে রান্নার কোন কাজও ছিল না। এক স্থানে আগুন লাগার কিছু সময় পর আরো একাধিক স্থানে আগুন ধরার বিষয়টি কোন ভাবেই স্বাভাবিক অগ্নিকান্ড হতে পারে না, এটা বোদ্ধামহলের অভিমত। সবকিছু পর্যালোচনা করে এটি উদ্দেশ্যমূলকই দাঁড়ায়। ঘনবসতিতে আগুন ও সরু রাস্তা হওয়ায় দমকলবাহিনীর গাড়ি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে সময় লেগেছে প্রায় চার ঘন্টা। ইতোমধ্যে প্রায় ৩ হাজার ঘর পুড়ে ছাই হয়।
আরো পড়ুন-অগ্নিকাণ্ডের প্রতিবাদ করায় রোহিঙ্গা নেতাকে হ’ত্যা
তার মতে, কে বা কারা আগুন লাগিয়েছে তা তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হতে পারে নি। যেহেতু আগুন লাগার আগের রাতেও দু’গ্রুপে গোলাগুলি হয়েছে। সবকিছু যাছাই করে তদন্ত কমিটি নিশ্চিত হয়েছে, আগুন লাগার ঘটনাটি আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে উদ্দেশ্য প্রণোদিত।
এডিএম বলেন, আমরা তদন্ত প্রতিদেবন দেয়ার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ এধরণের ঘটনা এড়াতে ১২টি সুপারিশ মালা উপস্থাপন করেছি। সেসবের মাঝে তদন্ত কমিটির প্রথম এবং প্রধান সুপারিশ হলো ঘটনার আদ্যপান্ত জানতে মামলা দায়ের করা। মামলা হলে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী অধিক তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে আইনের আওতায় আনতে সক্ষম হবে।
ছবি-কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো: শাহী ইমরানের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর করছেন তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) আবু সুফিয়ানসহ তদন্ত কমিটির সদস্যরা।
তদন্ত কমিটির সুপারিশে যা আছে:-
১) অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি পরিকল্পিত ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত নাশকতা বিবেচনায় একটি মামলা করা যেতে পারে এবং নিয়মিতভাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চিরুনি অভিযান পরিচালনা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে।
২) দশ লক্ষ্যাধিক এফডিএনএনদের জন্য স্বতন্ত্র এক বা একাধিক ফায়ারব্রিগেড ইউনিট এফডিএমএন ক্যাম্প এলাকার কেন্দ্রে স্থাপন করা যেতে পারে; কারণ, আগুনের ঘটনা অনেকটা নিয়মিত।
৩) শেল্টারের ত্রেপল ও বাঁশ ব্যবহারের পরিবর্তে বিকল্প শেল্টার উপকরণ ব্যবহারের বিষয়টি বিশেষভাবে বিবেচনা করা প্রয়োজন যা অপেক্ষাকৃত কম দাহ্য পদার্থের তৈরী।
৪) রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি ব্লকে প্রশস্ত রাস্তা নির্মানের ব্যবস্থা করতে হবে; এতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসে গাড়ি সহজে চলাচল করতে পারবে;
৫) ক্যাম্পের অভ্যন্তরে যত্রতত্র মার্কেট করা থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বড় রাস্তার ধার ব্যতীত অন্যকোন স্থানে দাহ্য পদার্থের আউটলেট করা থেকে বিরত রাখা।
৬) প্রতিটি ব্লকের কেন্দ্রে বা রাস্তার পাশে কংক্রিটের পানির চৌবাচ্চা বা জলাধার নির্মাণ করা এবং বর্তমানে ব্যবহৃত ওয়াটার নেটওয়াক সমূহে হাইড্রেন্ট পয়েন্ট রাখা।
ছবি-শহীদ এটিএম জাফর আলম হলরুমে সাংবাদিকদের সাথে কথা বলছেন তদন্ত কমিটি।
৭) শেল্টার সমূহ অধিক ঘনবসতিপূর্ণ ও অনেক স্থান যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে অগম্য বিবেচনায় ক্যাম্প সমূহের প্রবেশমূখে ক্যাম্পের একসেস রোড উল্লেখপূর্বক মানচিত্র স্থাপন করা যেতে পারে।
৮) ক্যাম্পে কোথাও আগুন লাগলে রোহিঙ্গারা যেন আগুন নেভাতে স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করতে পারে সেজন্য তাদেরকে নিয়মিত ফায়ার ফাইটিং প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
৯) এফডিএমএন ক্যাম্পের ব্লকগুলিতে বিভিন্ন পয়েন্টে ওয়ারলেস টাওয়ার স্থাপন করে সেখানে একইসাথে ৩৬০ ডিগ্রি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করে নজরদারি বাড়ানো যেতে পারে।
১০) এক ক্যাম্পে অপরাধ করে অন্য ক্যাম্পে যাতে পালিয়ে যেতে না পারে সেলক্ষ্যে প্রতিটি ক্যাম্পে পৃথকভাবে কার্যকর নিরাপত্তা বেষ্টনী নির্মাণ করা যেতে পারে।
১১) আগুন এর সূত্রপাত এর সাথে সাথে শেল্টারসমূহ হতে গ্যাস সিলিন্ডার সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এছাড়া, স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে অক্সিজেন সিলিন্ডার ও এসি সমূহ অগ্নিকান্ডের সূত্রপাত হবার সাথে সাথে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
১২) শেল্টার নির্মানের গাইডলাইন অনুযায়ী ক্যাম্প ১১ তে শেল্টার নির্মান করা হয়নি অর্থাৎ এক শেল্টারের থেকে অন্য শেল্টারের ন্যূনতম দুরুত্ব ৬ ফুট থেকে ১০ ফুট রাখার নিয়ম থাকলেও তা মানা হয়নি। ভবিষ্যতে মধ্যমেয়াদী শেল্টার নির্মানের ক্ষেত্রে এই নিয়ম সহ শেল্টার নির্মানের গাইডলাইন ভালোভাবে অনুসরণ করে শেল্টার নির্মান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
মন্তব্য করুন