বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৫৭ অপরাহ্ন

‘সুফল’ প্রকল্প: সাইনবোর্ডে সুফল বাগান !

‘সুফল’ প্রকল্প: সাইনবোর্ডে সুফল বাগান !

অনলাইন বিজ্ঞাপন

ছবি-রামু পানেরছড়া বিটের আওতায় সুফলের সাইনবোর্ড।

“সরকারি বনজ সম্পদ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন, বন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্ধারে স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণ এবং বনের উপর সরাসরি নির্ভরতা হ্রাসসহ বনজ সম্পদ উজাড়রোধে” কল্পে সরকার সাস্টেনেইবল ফরেস্ট এন্ড লাভলীহুডস প্রজক্ট (সুফল) বা টেকসই বন ও জীবিকা প্রকল্প গ্রহণ করেন। কিন্তু প্রকল্পের আওতায় বাগানে নামে মাত্র চারা রোপন করে কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্ত, রেঞ্জ এবং বিট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। এতে সুফল প্রকল্পের সুফল নিয়ে সঞ্চয় দেখা দিয়েছে। আলোকিত কক্সবাজারের ধারাবাহিক প্রতিবেদনে আজ সুফল প্রকল্পের অনিয়ম নিয়ে পড়ুন প্রতিবেদনের সপ্তম পর্ব।

।।ওয়াহিদ রুবেল।।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের আওতাধীন কক্সবাজার রেঞ্জের কলাতলী বিট হিমছড়ি কাইন্দা ভাঙ্গা পাহাড় নামক স্থানে টেকসই বন ও জীবিকা (সুফল) প্রকল্পের ১০০ হেক্টর এনরিচমেন্ট বাগান করেন। সাইনবোর্ডের হিসেব মতে, ২০২১-২০২২ সালে রোপন করা এ বাগানে চারা লাগানো হয়েছে ১ লাখ ৫০ হাজার। সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সাইনবোর্ডের লেখা তথ্যের সাথে বাস্তবতার কোন মিল নেই। বাগান করা হয়েছে তিন ভাগের একভাগের মতো। আর কিছু কিছু স্থানে চারার দেখা মিললেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মারা গেছে রোপিত চারার অর্ধেকের মতো।

কাইন্দা ভাঙা বনের একটু অভ্যন্তরে গিয়ে আরেকটি সাইনবোর্ডের দেখা মিলে। ২০১৯-২০ সনে ১০০ হেক্টর বাগানে আড়াই লাখ দ্রুত বর্ধনশীল গাছের চারা রোপন করার কথা বলা হয়েছে সাইনবোর্ডে। অথচ সাইনবোর্ডে লেখা অর্জুন, শিমুল, গামার, আমলকি, বহেরা, জারুল, ছাতিয়ানা গাছগুলো ধীর বর্ধনশীল গাছ। এছাড়া সাইনবোর্ডের পাশে লাগানো চারার কোন অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও মৃত প্রায় কিছু চারা চোখে পড়ে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনবিভাগের অনেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দ্রæত বর্ধণশীল, এনরিচমেন্ট বা সমৃদ্ধি করণ বাগানের সাইনবোর্ড দিয়েই কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের ডিএফও, রেঞ্জ কর্মকর্তা, বিট কর্মকর্তা মিলে কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। কাজের কাজ কিছুই হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বনে বসবাসকারীরা জানিয়েছেন, অফিসার পর্যায়ের লোকজন আসলে রাস্তার পাশে রোপিত চারা পরিদর্শন করানো হয়। এজন্যই আমাদের দৈনিক মুজুরিতে রাস্তার পাশে চারা রোপন করানো হয়েছে।

শুধু হিমছড়িতে নয়, সরেজমিনে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কে পানেরছড়া নামক স্থানে গিয়ে দেখা যায়, পানের ছড়া রেঞ্জের আওতাধীন পানেরছড়া বিট ২০ হেক্টর মিশ্র প্রজাতির দ্রুত বর্ধনশীল ‘সুফল’ প্রকল্পের বাগান করা হয়েছে। সাইনবোর্ডে ২০ হেক্টর জমিতে ৫০ হাজার চারা রোপনের দাবি করা হলেও বাস্তবে তার কয়েক হেক্টর জমিতে চারা রোপন করেছে বনবিভাগ। এছাড়া দ্রুত বর্ধণশীল বাগানের কথা বলা হলেও লাগানো হয়েছে দীর্ঘমেয়াদী ধীর বর্ধনশীল কড়ই, টাকিজাম, পুতিজাম, গামার, আমলকি, বাঁধাচূড়া, বজেরা, অর্জুন, জারুল, শিমুলসহ আরো বিভিন্ন প্রজাতির গাছের চারা। একই সাথে লাগানো হয়েছে আকাশমনি গাছের চারাও।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাগানে সুফল না আসলেও নিজেদের পকেটে সুফল তুলেছেন অসাধু কর্মকর্তারা।

কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের তথ্য মতে সুফল প্রকল্পের আওতায় ২০১৯-২০ থেকে ২০২১-২২ পর্যন্ত তিন অর্থবছরে মোট ৮ হাজার ৪শ হেক্টর বাগান করা হয়েছে। যেখানে দ্রæত বর্ধনশীল বাগান করা হয়েছে ৪ হাজার ৩০ হেক্টর, ধীর বর্ধনশীল বাগান ২ হাজার ৭শ হেক্টর, এনরিচমেন্ট বাগান ১১’শ ৪০ হেক্টর, হেবিটেট উন্নয়ন বাগান ২১০ হেক্টর, ঝাউ বাগান ১০৫ হেক্টর, এ.এন.আর বাগান ২৩ হেক্টর, বিপন্ন ও বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতির বাগান ২৭ হেক্টর, মেডিসিনাল বাগান ৬৫ হেক্টর, পি এন্ড ওয়াইল্ড লাইফ ১০০ হেক্টর বাগান। অথচ সরেজমিনে, কক্সবাজার রেঞ্জ, পানেরছড়া, টেকনাফ, ইনানী, ধোয়াপালং, রাজারকুল, উখিয়া, হোয়াইক্যং ও শীলখালী রেঞ্জের বাগানগুলো ঘুরে দেখা যায় সাইনবোর্ডের তথ্যের সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই, বরং উল্টো চিত্র। এসব বাগানের হিসেব শুধু কাগজে-কলমে ও সাইনবোর্ডে সীমাবদ্ধ। সাইনবোর্ডে চারার সংখ্যা ও গাছের প্রজাতির কথা উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে তার অস্থিত্ব পাওয়া যায়নি। আবার কোন জায়গায় চারা দেখা গেলেও পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে মারা যাচ্ছে অনেক চারা। আর যেখানে দ্রæত বর্ধনশীল চারা রোপন করার কথা সেখানে ধীর বর্ধনশীল চারা রোপন করা হয়েছে।

বনবিভাগের কর্মকর্তাদের অনিয়মের কারণে ২০১৯ সালে ১৪ সেপ্টেম্বর সুফল প্রকল্পের (টেকসই বন ও জীবিকা) অগ্রগতি নিয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির এক সভায় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী।

পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা জানিয়েছেন, এভাবে কাগজে কলমে বনায়ন দেখিয়ে অনিয়ম আর দুর্নীতির মাধ্যমে ‘সুফল’ প্রকল্পের কোটি কোটি টাকা আত্মসাত করেছে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের কর্মকর্তারা।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, প্রকল্পের নাম অনেক সুন্দর। কিন্তু কাজ ভাল না। বন কর্মকর্তারা নিজের সুফল বাড়িয়েছে, বাগানের সুফল আসে নি।

যদিও অভিযোগের বিষয়টি অস্বীকার করে কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মোঃ সারোয়ার আলম বলেন, নিয়ম মেনে বাগান করা হয়েছে। ধীরে ধীরে অসমাপ্ত বাগানগুলো করা হবে।

এ বিষয়ে জানতে প্রধান বন রাক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী এবং প্রকল্প পরিচালক গোবিন্দ রায়ের নাম্বারে ফোন করা হলে রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।


“‘সুফল’ প্রকল্প: সাইনবোর্ডে সুফল বাগান !” এ একটি মন্তব্য

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
Desing & Developed BY MONTAKIM