বুধবার, ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৬:৪১ পূর্বাহ্ন
আল্লাহ মানুষকে মানুষ হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টির প্রথম দিন থেকে তাকে অনন্য জ্ঞান ও মর্যাদায় ভূষিত করেছেন। অতঃপর মানুষ উত্তরাধিকার সূত্রে সেই জ্ঞান ও মর্যাদার অধিকারী হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী, আমি তোমাদের এক পুরুষ ও এক নারী থেকে সৃষ্টি করেছি। আর তোমাদের বিভিন্ন বংশ ও গোত্রে বিভক্ত করেছি, যেন তোমরা পরস্পর পরিচিতি লাভ করতে পারো।’ (সুরা হুজুরাত, আয়াত : ১৩)
মানবজাতির বিকাশের এই ধারা আল্লাহ নির্ধারণ করেছেন। তবে এর ব্যতিক্রমও তাঁর সামর্থ্যের বাইরে নয়। যেমন তিনি মাটি থেকে আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। আদম (আ.) থেকে হাওয়া (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। আদম ও হাওয়া (আ.) থেকে মানবজাতিকে সৃষ্টি করেছেন। আবার শুধু একজন নারী থেকে ঈসা (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ বলেন, ‘নিঃসন্দেহে আল্লাহর কাছে ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাকে মাটি দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন অতঃপর তাকে বলেছিলেন, হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেল।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৫৯)
মানবসৃষ্টি নিয়ে কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞান
মানবসৃষ্টির প্রক্রিয়া নিয়ে কোরআন ও আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষ্যে বিস্ময়কর মিল আছে। প্রায় দেড় হাজার বছর আগে অবতীর্ণ কোরআনের এসব অভ্রান্ত বক্তব্যই প্রমাণ করে কোরআন আল্লাহর পক্ষ থেকে অবতীর্ণ ঐশী গ্রন্থ। নিম্নে মানবসৃষ্টি বিষয়ে কোরআনের এমন কিছু বক্তব্য তুলে ধরা হলো, যা আধুনিক বিজ্ঞান সমর্থন করে।
১. জীবকোষ ও পানি : পবিত্র কোরআনে আল্লাহ বলেছেন, ‘আর প্রাণবান সব কিছু সৃষ্টি করলাম পানি থেকে। তবু কি তারা ঈমান আনবে না?’ (সুরা আম্বিয়া, আয়াত : ৩০)
আধুনিক জীববিজ্ঞানের মতে, সাগরের অভ্যন্তরের পানিতে যে প্রটোপ্লাজম বা জীবনের আদিম মূলীভূত উপাদান রয়েছে তা থেকেই সব জীবের সৃষ্টি। আবার সব জীবদেহ কোষ দ্বারা গঠিত। আর এই কোষ গঠনের মূল উপাদান হচ্ছে পানি। ভিন্নমতে, পানি অর্থ শুক্র। (কুরতুবি)
২. পানি ও মাটির সম্পর্ক : পবিত্র কোরআনের একাধিক স্থানে বলা হয়েছে, মানবজাতিকে মাটি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। যেমন আল্লাহ বলেন, ‘কাদামাটি থেকে মানব সৃষ্টির সূচনা।’ (সুরা সাজদা, আয়াত : ৭)
অন্য আয়াতে এসেছে, ‘পোড়া মাটির মতো শুষ্ক মাটি থেকে (মানুষকে) সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা আর-রহমান, আয়াত : ১৪)
আধুনিক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা দেখা গেছে, মাটির অনেক উপাদান মানবদেহে বিদ্যমান। কার্বন, হাইড্রোজেন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন, ফসফরাস, সালফারসহ মাটির প্রায় ২৬টি উপাদান মানুষের শরীরে পাওয়া যায়। পবিত্র কোরআনে বিষয়টি এভাবে তুলে ধরা হয়েছে, ‘আর অবশ্যই আমি মানুষকে মাটির নির্যাস থেকে সৃষ্টি করেছি।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২)
৩. মাতৃগর্ভের ধারাবাহিক স্তর : মাতৃগর্ভে সন্তান গঠনের চক্র সাধারণত দীর্ঘ ২৮০ দিন হয়, যা ৪০ দিন অন্তর সুনির্দিষ্ট সাতটি চক্রে বিভক্ত। পবিত্র কোরআনে সাতটি স্তর এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ‘আমরা মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অতঃপর আমরা তাকে শুক্রবিন্দুরূপে এক সংরক্ষিত আঁধারে (জরায়ুতে) স্থাপন করেছি। এরপর শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি, অতঃপর জমাট রক্তকে মাংসপিণ্ডে পরিণত করেছি, এরপর মাংসপিণ্ড থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি, অতঃপর অস্থিকে গোশত দ্বারা আবৃত করেছি, অবশেষে তাকে নতুনরূপে করেছি।’ (সুরা মুমিনুন, আয়াত : ১২-১৪)
আধুনিক বিজ্ঞানের বক্তব্যও অনুরূপ। তা হলো, নারী-পুরুষের যৌন মিলনের সময় নারীর ডিম্বনালির ফানেলের মতো অংশে ডিম্বাণু নেমে আসে। ওই সময় পুরুষের নিক্ষিপ্ত বীর্যের শুক্রাণু জরায়ু বেয়ে ওপরে উঠে আসে এবং তা ডিম্বনালিতে প্রবেশ করে। এভাবে নারীর ডিম্বাণু নিষিক্ত (ঋবৎঃরষরুধঃরড়হ) হয় এবং নিষিক্ত ডিম্বাণুটি জরায়ুতে নেমে প্রোথিত (ঊসনবফফবফ) হয়। (গাইনোকলজি শিক্ষা, পৃষ্ঠা : ২২)
নারী ও পুরুষের বীর্যের সংমিশ্রণ ঘুরতে থাকে এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এর চতুর্দিকে একটি আবরণের সৃষ্টি হয়। যাতে করে ভ্রূণটি ধ্বংস হতে না পারে। এরপর আস্তে আস্তে একবিন্দু রক্তকণায় পরিণত হয় এবং সেই রক্তকণা গোশতপিণ্ডে ও অস্থিমজ্জায় পরিণত হয়, এভাবেই সৃষ্টি হয় মানবশিশু। (বিজ্ঞান না কোরআন, পৃষ্ঠা ১০৯-১১০)
৪. মাতৃগর্ভের পরিবেশ : মাতৃগর্ভে আল্লাহ শিশুর পরিপূর্ণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন। শিশুরা মাতৃগর্ভে তিনটি পর্দার অন্তরালে অবস্থান করে। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের সৃষ্টি করেছেন তোমাদের মাতৃগর্ভে পর্যায়ক্রমে। একের পর এক ত্রিবিধ অন্ধকারে।’ (সুরা ঝুমার, আয়াত : ৬)
আধুনিক চিকিত্সা বিজ্ঞানও কোরআনে বর্ণিত তিন স্তরের নিরাপত্তার কথা স্বীকার করেছে। তা হলো, ১. রেহেম, ২. মাশিমা বা গর্ভফুল এবং ৩. মায়ের পেট। রেহেমে রক্তপিণ্ড ছাড়া সন্তানের আকার-আকৃতি কিছুই তৈরি হয় না। আর গর্ভফুল (চষধপবহঃধ) ভ্রূণ বৃদ্ধি, সংরক্ষণ, প্রতিরোধ ইত্যাদি কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখে। (বাইবেল, কোরআন ও বিজ্ঞান, পৃষ্ঠা ২৭৭)
৫. শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ : মহান আল্লাহ বলেন, ‘নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন। যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্রসন্তান দান করেন। অথবা তাদের পুত্র-কন্যা উভয় দান করেন এবং যাকে ইচ্ছা বন্ধ্যা করে দেন। নিশ্চয়ই তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল।’ (সুরা শুরা, আয়াত : ৪৯-৫০)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘পুরুষের বীর্য স্ত্রীর বীর্যের ওপর প্রাধান্য লাভ করলে পুত্রসন্তান জন্ম নেয়। আবার স্ত্রীর বীর্য পুরুষের বীর্যের ওপর প্রাধান্য লাভ করলে কন্যাসন্তান জন্ম নেয়।’ (মুসলিম, মিশকাত, হাদিস : ৪৩৪)
আধুনিক স্বাস্থ্য বিজ্ঞানের মতে, জরায়ুতে যদি কন্যা ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তাহলে করটিকস কম্পোন্যান্টগুলো (ঈড়ৎঃরপং ঈড়সঢ়ড়হধহঃ) বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলো (গবফঁষষধৎ ঈড়সঢ়ড়হধহঃ) কমতে থাকে। পক্ষান্তরে জরায়ুতে যদি পুত্র ভ্রূণ সৃষ্টি হয়, তাহলে করটিকস কম্পোন্যান্টগুলো (ঈড়ৎঃরপং ঈড়সঢ়ড়হধহঃ) কমতে থাকে এবং মেডুলার কম্পোন্যান্টগুলো (গবফঁষষধৎ ঈড়সঢ়ড়হধহঃ) বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে থাকে। তা ছাড়া মানুষের প্রতিটি দেহকোষে মোট ২৩ জোড়া ক্রমোজম থাকে। তন্মধ্যে ২২ ঝোড়া অটোজম এবং এক জোড়া সেক্স (ঝবী) ক্রমোজম। নারীর ডিম্বাণুতে ঢঢ ক্রমোজোম এবং পুরুষের শুক্রাণুতে ঢণ ক্রমোজম থাকে। সুতরাং নারীর ডিম্বাণুর ঢ ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর ঢ ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে ঢঢ এবং কন্যাসন্তানের জন্ম হবে। পক্ষান্তরে নারীর ডিম্বাণুর ঢ ক্রমোজমকে যদি পুরুষের শুক্রাণুর ণ ক্রমোজম নিষিক্ত করে, তবে জাইগোটের ক্রমোজম হবে ঢণ এবং পুত্রসন্তান জন্ম হবে। (মাধ্যমিক সাধারণ বিজ্ঞান, জীবকোষের গঠন ও প্রকৃতি অধ্যায়, পৃষ্ঠা : ১৬১)।
সূত্র-কালেরকণ্ঠ
মন্তব্য করুন