বুধবার, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৪:৪৬ অপরাহ্ন
ছবি-সংগ্রহীত।
মাইমুনা আক্তার:
মক্কার ‘মুদলাজ’ গোত্রের সন্তান সুরাকাহ (রা.)। হিজরতকালে রাসুল (সা.)-কে হত্যার হীন উদ্দেশ্যে ধাওয়াকারীদের একজন। রাসুল (সা.)-কে ধাওয়া করতে গিয়ে পড়ে যান মহা বিপদে। বিপদ থেকে মুক্তি লাভ করেন রাসুল (সা.)-এর দোয়ার বদৌলতে।
ফিরে যান স্বগোত্রের দিকে রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে লিখিত একটি অঙ্গীকারপত্র নিয়ে। ৮ম হিজরি সনে মক্কা বিজয় শেষে তায়েফ যুদ্ধের পর ইসলাম গ্রহণ করেন।
রাসুল (সা.) যখন আবু বকর (রা.)-কে সঙ্গে করে মক্কা ছেড়ে মদিনার উদ্দেশে রওনা হলেন, তখন আবু জাহেল ও তার বাহিনী হন্যে হয়ে রাসুল (সা.)-এর তালাশে বেরিয়ে পড়ল। সাওর পর্বত পর্যন্তও এসে পৌঁছেছিল তারা, যখন রাসুল (সা.) ও আবু বকর (রা.) ওই পর্বতের একটি গুহার অভ্যন্তরে লুকিয়ে ছিলেন। ভেতর থেকে তাঁরা দুর্বৃত্তদের পা দেখছিলেন। এদিকে মক্কায় ঘোষিত হলো, যে ব্যক্তি মুহাম্মদকে জীবিত বা মৃত ধরে দিতে পারবে, তাকে এক শ উট পুরস্কার দেওয়া হবে। এই ঘোষণা সুরাকাহ ইবনে মালিকের কানেও বাড়ি খেল। সুরাকাহ অতি গোপনীয়তা রক্ষা করে তীর-তরবারি ও প্রয়োজনীয় আসবাবপত্রসহ বেরিয়ে পড়লেন অশ্ব নিয়ে। একশ উট যেন তিনি একাই লাভ করতে পারেন, সে জন্য গোপনীয়তা বজায় রেখে চললেন।
দ্রুতগতিতে অশ্ব হাঁকিয়ে চললেন সুরাকাহ। কিছু দূর যাওয়ার পর তাঁর ঘোড়াটি মারাত্মকভাবে হোঁচট খেয়ে পড়ল। উঠলেন, আবার ঘোড়া হাঁকালেন। একে একে তিনবার তাঁর ঘোড়া হোঁচট খেয়ে পড়ল। দ্বিতীয়বার যেখানে ঘোড়াটি হোঁচট খেয়েছিল, সেখান থেকে তিনি দেখতে পেলেন রাসুল (সা.) ও তাঁর সঙ্গী আবু বকর (রা.)-কে। ভাবলেন, এখনই সুযোগ। তাই তাক করলেন তীর-ধনুক। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত অসাড় হয়ে গেল। শুধু তা-ই নয়, শক্ত মাটির মধ্যে তাঁর ঘোড়ার পা গেড়ে যেতে লাগল এবং সামনের দিক থেকে ধোঁয়া এসে তাঁকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে ফেলল। এর পরও তিনি এক শ উটের লোভে ঘোড়াটি হাঁকাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ঘোড়াটি তার পাগুলো মাটির ভেতর থেকে বের করতে পারল না।
নিরুপায় হয়ে অত্যন্ত বিনয়ের স্বরে রাসুল (সা.)-কে ডাক দিয়ে বলেন, আপনারা আপনাদের প্রভুর দরবারে আমার ঘোড়ার জন্য দোয়া করুন। আমি আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না। রাসুল (সা.) দোয়া করলেন। ঘোড়ার পা স্বাভাবিক হলো। আবারও এক শ উটের নেশা তাঁকে মাতাল করে তুলল। অসৎ উদ্দেশ্যে ঘোড়া হাঁকালেন রাসুল (সা.)-এর দিকে। আগের চেয়েও আরো মারাত্মকভাবে ঘোড়ার পা মাটিতে গেড়ে গেল। এবার তিনি অনুতপ্ত হলেন। সাহায্য চাইলেন রাসুল (সা.)-এর কাছে আগের মতো এবং দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, আমি এই বিপদ থেকে মুক্তি পেলে আমার যাবতীয় আসবাব আপনাদের দিয়ে আমি পেছনের দিকে ফিরে যাব এবং আপনাদের পেছনে ধাবমান ব্যক্তিদের অন্য দিকে ফিরিয়ে দেব। রাসুল (সা.) এবারও দোয়া করলেন। ঘোড়া মুক্ত হলো। এরপর তিনি রাসুল (সা.)-কে ডেকে বলল, আপনাদের সঙ্গে আমি কিছু কথা বলতে চাই। আল্লাহর কসম! আপনাদের কোনো ক্ষতি করব না।
রাসুল (সা.) ও তাঁর সঙ্গী আবু বকর (রা.) বলেন, তুমি আমাদের কাছে কী চাও? তিনি বলেন, বুঝতে পেরেছি আমি অতি শিগগির আপনার দ্বিন জয় লাভ করবে। আপনি আমাকে কথা দিন—‘আমি যখন আপনার সাম্রাজ্যে যাব, তখন আপনি আমাকে সম্মান দেবেন; অপমান করবেন না’ এবং এ কথাটি লিখেও দিন, যাতে আমি যথাসময়ে তা দলিলস্বরূপ পেশ করতে পারি। রাসুল (সা.) তাঁর আরজি মঞ্জুর করলেন। আবু বকর (রা.)-কে তা লিখে দিতে বলেন। তিনি একখণ্ড হাড়ের ওপর কথাগুলো লিখে দিলেন।
সুরাকাহ (রা.) ফিরে যাচ্ছেন এমন সময় রাসুল সা. তাঁকে বললেন, সুরাকাহ! এমন একদিন আসবে যেদিন তুমি কিসরার রাজকীয় পোশাক পরিধান করবে। সে দিনটি কেমন হবে? সুরাকাহ (রা.) বিস্ময়ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তার মানে কিসরা ইবনে হুরমুজ? রাসুল (সা.) বলেন, হ্যাঁ কিসরা ইবনে হুরমুজ।
সুরাকাহ (রা.) ফিরে গেলেন। সযতেœ সংরক্ষণ করে রাখলেন রাসুল (সা.)-এর পক্ষ থেকে আবু বকর (রা.)-এর হাতে লিখিত চিরকুটটি। এরই মধ্যে পার হলো দীর্ঘ আট বছর। ৮ম হিজরি সনে রাসুল (সা.) বিজয়ীর বেশে প্রবেশ করলেন মক্কা নগরীতে। এরপর তায়েফ অভিযান হলো। অভিযান শেষে রাসুল (সা.) জিইররানা নামক স্থানে অবস্থান করলেন। এমন সময়ে সেই আট বছর আগের চিরকুটটি নিয়ে হাজির হলেন সুরাকাহ ইবনে মালিক (রা.)। তখন রাসুল (সা.)-এর চতুর্দিকে আনসার সাহাবিদের ভিড়। তিনি তাদের ভিড় অতিক্রম করে সোজা উপস্থিত হলেন রাসুল (সা.)-এর কাছে। চিরকুটটি উঁচু করে বলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি হলাম সুরাকাহ। এই হলো আপনার অঙ্গীকারপত্র। দয়ার নবী (সা.) ইরশাদ করলেন, ‘কাছে এসো! আজ প্রতিশ্রুতি পূরণ করার দিন; আজ সদ্ব্যবহারের দিন। ’ সুরাকাহ (রা.) বলেন, তখন আমি রাসুল (সা.)-এর সামনে আমার ইসলামের ঘোষণা দিলাম।
সময়ের চাকা ঘুরে এলো উমর (রা.)-এর খেলাফতকাল। তাঁর খেলাফতের শেষ দিকে পারস্য বিজয় হলো। মুসলিম বাহিনী পারস্য সম্রাটকে শোচনীয়ভাবে পরাজিত করে তাদের দুর্গগুলো তছনছ করে দিল। সঙ্গে নিয়ে এলো রাজকীয় পোশাক-আশাকসহ দামি দামি অনেক কিছু। খলিফার সামনে সব স্তূপীকৃত করে রাখা হলো।
খলিফা উমর (রা.) স্তূপীকৃত গনিমতের মাল থেকে কিসরার জামা, জুতা ও অন্যান্য পোশাক বের করে তা সুরাকাহ (রা.)-কে পরালেন, তরবারি ঝুলিয়ে দিলেন তাঁর গলায়, কোমরে বাঁধলেন তার বেল্ট, মাথায় রাখলেন মুকুট এবং হাতে পরালেন বালা।
উমর (রা.) কিসরার শাহি সরঞ্জাম সুরাকাহ (রা.)-কে পরিয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে বলেন, বাহ! মুদলাজ গোত্রের এক বেদুইনের মাথায় শোভা পাচ্ছে শাহেনশাহ কিসরার মুকুট; হাতে বালা। এভাবে সুরাকাহ (রা.) এর ব্যাপারে রাসুল (সা.)-এর ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হলো। (উসদুল গাবাহ ২/১৭৯—১৮০; আল-ইসতিআব ২/৫৮১—৫৮২)
নবীজি (সা.)-এর এই প্রিয় সাহাবি তৃতীয় খলিফা উসমান (রা.)-এর খেলাফতামলে ২৪ হিজরি সনে ইন্তেকাল করেছেন। কোনো কোনো বর্ণনা মতে, উসমান (রা.)-এর খেলাফতকালের পরে ইন্তেকাল করেছেন। (উসদুল গাবাহ : ২/১৮১)।
সূত্র-কালেরকণ্ঠ
মন্তব্য করুন