শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:১৮ পূর্বাহ্ন
ফাইল ছবি রোহিঙ্গা ক্যাম্প।
।।ওয়াহিদ রুবেল।।
পাঁচ বছর আগে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আসেন প্রায় সাড়ে এগারো লাখ রোহিঙ্গা। শুরুতেই নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় উখিয়া ও টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দারা। আর সরকার বনের প্রায় ৮ হাজার একর জমিতে ৩২টি ক্যাম্প স্থাপন করে তাদের বসবাস করা সুযোগ করে দেয়। কিন্তু মানবিক সাহায্য পাওয়া রোহিঙ্গারাই এখন স্থানীয়দের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আশ্রিত রোহিঙ্গাদের চাপে স্থানীয়দের জীবন ও জীবিকায় চরম প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে দ্বন্দ্ব সংঘাতে জড়িয়ে খুন ও অপহরণের মতো ঘটনায় নিরাপত্তা নিয়ে সঞ্চয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয়দের দাবী, রোহিঙ্গাদের কারণে শুধু জনজীবনে প্রভাব পড়েছে এমনটা নয়, ধ্বংস হয়েছে বনভূমি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে প্রকৃতি পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের। নষ্ট হয়েছে শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ। শ্রম বাজার দখল হওয়ায় বেকার হয়ে পড়ছেন স্থানীয়রা। আর ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমেছে দিন দিন।
যেসব প্রভাব পড়ছে স্থানীয়দের জীবনে;
কৃষিতে প্রভাব;
কুতুপালং পাশ্চিম পাড়ার কৃষক মো: সালাম ও আলী আহম্মদ জানান, রোহিঙ্গা আসার পূর্বে দুইজনই পাঁচ একরের বেশি জমিতে চাষ করতেন। চাষের ফসল দিয়ে পরিবার পরিজন নিয়ে জীবন যাপন করতেন। তাদের সে জমিতেই রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি করা হয়েছে। এছাড়া রোহিঙ্গাদের বর্জ্য জমিতে এসে পড়ায় চাষাবাদ করা যাচ্ছে না। এখন কোন রকম দিন মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন তারা।
ছবি-কৃষি জমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আসা বর্জ্য।
রাজাপালং ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য ও কুতুপালং এলাকার বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার হেলাল উদ্দিন বলেন, শুধু সালাম বা আলী আহম্মদ নয়, কুতুপালং এলাকায় প্রায় কয়েক শত একর চাষযোগ্য জমিই নষ্ট হয়ে গেছে। রোহিঙ্গা আসার আগে যেখানে জুম চাষ হতো যেখানে রোহিঙ্গা বসতি। ফলে খাদ্যশষ্য উৎোদন হ্রাস পেয়েছে।
তবে কি পরিমাণ চাষের জমি নষ্ট হয়েছে তার কোন তথ্য নেই কৃষি অফিসে।
বনভূমি ধ্বংস:
একটা সময় উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালী, থাইংখালী, পালংখালী, হোয়াইক্যং লেদা এলাকায় ঘন বন ছিল। রোহিঙ্গা আসার পর প্রায় আট হাজার একর বন ও বনের ভূমি ধ্বংস হয়েছে। বন ধ্বংস করে গড়ে তোলা হয়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ধ্বংস করা হয়েছে পাহাড়। বর্তমানে পাহাড়ী বনের কাঠ কেটে জ্বালানি ব্যবহার করছে অনেক রোহিঙ্গা। এতে হুমকির মুখে পড়েছে বন্যপ্রাণীরাও। আর পরিবেশের উপর চরম প্রভাব পড়েছে। বন ধ্বংস হওয়ায় বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এসব এলাকায় জীব বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। বিশেষ করে বন্যহাতি চলাচলে বাধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এতে অনেক সময় হাতির পাল লোকালয়ে ঢুকে পড়ে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বনবিভাগের বিভাগীয় বনকর্মকর্তা (ডিএফও) সরওয়ার আলম বলেন, রোহিঙ্গাদের জন্য নষ্ট হয়েছে ৮ হাজার একর একর বনভূমি। এতে বন্যপ্রাণী হারিয়েছে তাদের আবাসস্থল।
তিনি বলেন, কক্সবাজারের বনাঞ্চলে ৬৩টি হাতি রয়েছে। এসব হাতির চলাচলের জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তে তুলাবাগান-পানেরছড়া, নাইক্ষ্যংছড়ি-রাজারকুল ও উখিয়া-ঘুনধুম নিয়ে তিনটি করিডোর রয়েছে। রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনের কারণে এরই মধ্যে উখিয়া-ঘুমধুম করিডোরটি বন্ধ হয়ে গেছে। তবে আমরা পরিবেশ পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
তিব্র পানি সংকটের আশঙ্কা:
মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গাদের পানির চাহিদা মেঠাতে শুরুতেই ৯ হাজারের বেশি স্যালোটিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছিল। অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের কারণে উখিয়া-টেকনাফে ভূগর্ভস্থ পানির স্তার দিন দিন নিচে নামছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে লবনাক্ত পানির পরিমাণ বাড়বে। এ জন্য ভূগর্ভস্থ পানির নির্ভরতা কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানির ওপর জোর দিতে হবে বলে জানিয়েছেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা।
তাদের তথ্য, গাছ তার শেকড়ের সঙ্গে পানি ধরে রাখে। এ কারণে ভূ-পৃষ্ঠে পানির স্তর উপরের দিকে থাকে। যখন গাছ মরে যায় বা ধ্বংস করা হয় তখন সেখানে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। কক্সবাজারে অতিরিক্ত পানি উত্তোলন ও বন উজাড়ের কারণে পানির স্তর নিচে নামছে। এটা রোধ করা না গেলে ভবিষ্যতে কঠিন বিপদ অপেক্ষা করছে।
তবে বৃষ্টির পানি ধরে রেখে সার্ফেস ওয়াটারের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী আবুল মনজুর।
তিনি বলেন, শুরুতেই যেসব টিউবওয়েল স্থাপন করা হয়েছিল সেগুলোতে আর পানি আসেনা। এ কারণে উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে ৮০০ মিটার গভীর থেকে মোটরে পানি উত্তোলন করে রোহিঙ্গাদের মাঝে সরবরাহ করা হয়। এছাড়া টেকনাফে সার্ফেস ওয়াটর সরবরাহ করা হচ্ছে।
শ্রম বাজার;
রোহিঙ্গা শিশু ফয়সাল (১১)। তার সাথে প্রতিবেদকের দেখা হয় কক্সবাজার বাসটার্মিনাল এলাকায় একটি চায়ে’র দোকানে। সেখানে শিশুটি বয় হিসেবে কাজ করছে। সে রোহিঙ্গা ক্যাম্প-১৩ এর আমান উল্লাহর ছেলে। শুধু শিশু ফয়সাল নয়, কিশোর-যুবক-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে নারীরাও এখন ক্যাম্প ছাড়ছেন টাকা আয়ের আশায়। তথ্য মতে, স্বল্প মূল্যে বেশি শ্রম পাওয়ায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরাও রোহিঙ্গাদের কাজে লাগাচ্ছেন। ফলে দিন দিন শ্রম বাজার দখলে যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের। আর বাড়ছে বেকার সমস্যা।
পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন বলেন, রোহিঙ্গাদের দোষ দিয়ে কি হবে। আমরা তো স্বল্পমূল্যে রোহিঙ্গাদের কাজ লাগাতে পারি। তাই কৃষি কাজ থেকে শুরু করে দিন মজুরসহ প্রয়োজনীয় কাজে রোহিঙ্গাদের ব্যবহার করছি।
অপরাধ বৃদ্ধি:
রোহিঙ্গাদের কারণে চরম নিরাপত্তাহীনতায় স্থানীয়রা। সর্বশেষ রবিবার টেকনাফের বাহারছড়ার জাহাজচুরা এলাকা থেকে ৮ জনকে অপহরণ করেছেন রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীরা। এছাড়া ক্যাম্পের অভ্যন্তরে নিজেদের দ্বন্দ্ব, সংঘাত, অপহরণ ও খুনসহ নানা ঘটনায় আতংকে থাকেন তারা।
স্থানীয়দের অভিযোগ রোহিঙ্গারা তাদের ইচ্ছে মতো ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে আসা যাওয়া করতে পারে। ফলে অপরাধ করেই অপরাধীরা ক্যাম্প ছাড়তে পারে। এমন কি দেশের যেকোন স্থানে যেতে পারে নির্বিঘ্নে। তবে, আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ক্যাম্পে দায়িত্বরত এপিবিএন।
৮ এপিবিএন এর সহকারী পুলিশ সুপার (মিডিয়া) বলেন, জনবল সংকটের কারণে পুরো ক্যাম্পের সব জায়গায় পাহারা বসানো সম্ভব না।ফলে অপরাধীরা ক্যাম্পের নানা স্থান দিয়ে গোপনে চলে যেতে পারে। এমন কি সুযোগ বুঝে তার কেটে পালিয়ে যায়।
মাদকের ব্যাপকতাঃ
২০১৭ সালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পরেই মাদকের ব্যাপকতা বেড়েছে। প্রতিদিন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ইয়াবাসহ আটক হচ্ছে রোহিঙ্গা মাদক পাচারকারীরা। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অধরা থেকে যাচ্ছে। আর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে ইয়াবা ও আইস। ফলে দিন দিন বাড়ছে মাদকাসক্তের সংখ্যা। নৈতিক অবক্ষয় হচ্ছে সমাজ ব্যবস্থায়। জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে এক বছরে মাদকের মামলা হয়েছে ৮২৪ টি। এ অবস্থায় মাদকের ব্যাপকতা রোধ করতে দ্রুত রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়া রোধ করতে হবে।
মন্তব্য করুন