ফাইল ছবি।
‘উন্নয়ন’ ও ‘পরিবেশ’ নাকী পরস্পর বিরোধী বিষয়। অন্তত দেশের জ্ঞানী-গুণী মানুষ, বিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয় প্রফেসরদের কাছ থেকে আমরা হরহামেশায় এমন বক্তব্য শুনে আসছি। কিন্তু কারো এমন বক্তব্য শুনে আমার মনের ভেতরে প্রতিক্রিয়া হয়, মেজাজও কিছুটা খারাপ হয়। এ বক্তব্যকে শিশুর মতো অবোধ কারো বাক্য বলে মনে হয়!
আমার প্রশ্ন হল- ‘উন্নয়ন’ কেন ‘পরিবেশ’ এর জন্য ক্ষতিকারক হবে? আর ক্ষতিকারক কোন কাজকে আমরা ‘উন্নয়ন’ বলব কেন? প্রকৃত অর্থেই যদি কোন ‘উন্নয়ন’ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলো তো নিশ্চয় পরিবেশেরও উন্নয়ন হবে।
আল্লাহ মানুষকে শ্রেষ্ঠ জীব বা আশরাফুল মখলুকাত হিসাবে সৃষ্টি করেছেন এবং এই পৃথিবীর তদারককারী বানিয়ে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। যার কারণে মানুষের সংস্পর্শে এসে প্রকৃতি বলবান হয়। অনেকেই হয়তো বলবেন মানুষের সংস্পর্শে প্রকৃতি ধ্বংস হয়; কারণ সেটাই আমরা দেখে আসছি। আসলে বিষয়টি এভাবেই বলা উচিত- অসভ্য মানুষের সংস্পর্শে প্রকৃতি ধ্বংস হয়, সভ্য মানুষের সংস্পর্শে প্রকৃতি আরো সমৃদ্ধ হয়।
মানুষসহ পৃথিবীর প্রায় সকল প্রাণীর শারীরিক বর্জ্যই বৃক্ষরাজির জন্য উপকারী। এসব বর্জ্য পৃথিবীর উর্বরা শক্তিকে আরো বৃদ্ধি করছে এবং উদ্ভিদের বেশি পরিমাণে অক্সিজেন উৎপাদনে সহায়তার মাধ্যমে বায়ূমন্ডলে অক্সিজেন এর ভারসাম্য ঠিক রাখতে ভ‚মিকা রাখছে। এমনকি মানুষের নি:শ^াস নি:সৃত কার্বন ডাই অক্সাইড খেয়ে বেঁচে বেড়ে ওঠে আমাদের বৃক্ষরাজি। মানুষ না থাকলে পৃথিবীর অনেক প্রাণী ও উদ্ভিদ টিকে থাকতে পারবে না; মানুষের সাথে তারাও গণবিলুপ্তির শিকার হবে। আবার বহু প্রাণী ও উদ্ভিদ রয়েছে, যাদের অস্তিত্বের উপর নির্ভর করছে মানুষের অস্তিত্ব। প্রকৃতিতে এক প্রজাতির অস্তিত্বের উপর নির্ভর করছে অপর প্রজাতির অস্তিত্ব। একটি প্রজাতির প্রাকৃতিক অভ্যাস-আচরণে লাভবান হচ্ছে অন্য প্রজাতি। এভাবে প্রকৃতিতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হয়েছে, যাতে একজনের কার্যকলাপে অপরের উপকার হয় এবং কারো ক্ষতি হয় না। আর প্রকৃতিতে এ আদর্শ অনুপাত যখন ভেঙ্গে পড়ে, তখনই পরিবেশগত বিপর্যয় ঘটে। মানুষের জন্য যে পরিবেশ উপকারী, তাকেই আদর্শ পরিবেশ বলা হয়। আর পরিবেশতো সবচেয়ে বেশি দরকার মানুষের জন্যই, উন্নয়নও। তবে আগে ভাবতে হবে- আসলেই আমরা কি উন্নয়ন করছি?
আমি নিজেকে দিয়েই উদাহরণটা দিতে চাই। মাত্র এক দশক আগেও দরিয়ানগর ‘বানরের পাহাড়ে’ এত পশু-পাখি প্রজনন করতে আসতো না। কিন্তু আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে নানা ‘উন্নয়ন’ করার পর এখানে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য গড়ে ওঠল। এরপর অভয়ারণ্য হয়ে গেল। যারা দরিয়ানগরে আগে এসেছেন এবং এখনও মাঝেমধ্যে আসেন, তারা এই পরিবর্তনটা স্পষ্ঠভাবে বুঝতে পারছেন বলে আশা রাখি।
রাজনীতিবিদরা নাকী শোককে শক্তিতে পরিণত করতে পারেন! আমরা কি পারব না, প্রকৃতির উপর এ্যানথ্রোপোজেনিক স্ট্রেস বা মনুষ্যঘটিত ক্ষতিকর প্রভাবকে, প্রাকৃতিক সদস্যদের যথাযথ অনুপাতের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য তৈরি করে; আশীর্বাদে পরিণত করতে?
ধরুন, প্লাস্টিক এ্যাসফল্টে বা বিটুমিনে মেশালে তার বৈশিষ্ট হারায় বা তার ধর্ম নি:শেষ হয়ে যায়। এছাড়া প্লাস্টিকখেকো সুপারওয়ার্ম বা কৃমিরা প্লাস্টিক খেয়ে মাটি উৎপাদন করে। মানুষের প্রতিদিনের নিক্ষিপ্ত মল থেকে বায়োগ্যাস পদ্ধতিতে ৬৫ ওয়াট/চব্বিশ ঘন্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। মাত্র ১০ জন মানুষের প্রতিদিনের প্র¯্রাব দিয়ে এক একর জমির চাষাবাদ করা সম্ভব। এতে আলাদা রাসায়নিক সারের কোন প্রয়োজন নেই।
১৫ বছর আগে বাঁকখালী নদীতীরে জাপানী সংস্থা ওয়েস্কার সহায়তায় ৬০ হেক্টর ম্যানগ্রোভ উদ্ভিদের বাগান গড়ে তোলা হয়েছে। ২০০৭ সালে তৎকালীন যৌথবাহিনী প্রধান কর্ণেল আনিসের নেতৃত্বে স্থানীয় পরিবেশবাদীরা নদীতীরের কাদা মাটিতে নেমে চারা রোপন করেন। এরপর চারা গাছ বড় হয়ে বৃক্ষে পরিণত হয় এবং ধীরে ধীরে নানা পাখ-পাখালীর কলতানে মুখরিত হয়ে ওঠে এলাকাটি।
এগুলো আমাদের চোখের সামনে ঘটে যাওয়া ইতিবাচক ঘটনাগুলোর ছোট্ট উদাহরণ। কিন্তু আমাদের অপরিকল্পিত ‘উন্নয়ন’ কর্মকান্ডে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি হচ্ছে। যার কারণে উন্নয়ন বলতেই আমরা বুঝি প্রকৃতি ধ্বংস হওয়াকে।
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের সাগরদ্বীপ। করোনার কারণে পর্যটন শিল্প বন্ধ থাকায় ওখানকার লাল কাঁকড়াগুলো খাদ্য সংকটে পড়ে যায়। যে কারণে হাজার হাজার লাল কাঁকড়া মারা যায়। মানুষের অনুপস্থিতির কারণে সংকটে পড়ে প্রকৃতির একটি সদস্য। এই সদস্যটি আবার সৈকতের প্রধান বায়োটার্বেটর- বা মাটি ও পানির জৈব রাসায়সিক গুণাগুণ পরিবর্তনকারী। জানিনা, এই লাল কাঁকড়ার অভাবে সাগরদ্বীপের অন্যান্য প্রাণীকুল এবং মাটি ও পানির উপর কী নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল।
একসময় কক্সবাজার সৈকতেরও প্রধান বায়োটার্বেটর্স ছিল লাল কাঁকড়া। কিন্তু তাকে এখন আগের মতো দেখা যায় না, কেবল সৈকতের কয়েকটি সুনির্দিষ্ট পয়েন্টেই দেখা যায়। কিন্তু আমরা চাইলে পুরো সৈকতকেই লাল কাঁকড়ায় ভরিয়ে দিতে পারব।
আমি লাল কাঁকড়াকে জানি। সে আমার ডাকে সাড়া দেয়! কক্সবাজারের ১২০ কিলোমিটার সৈকতের যেখানেই বলুন না কেন, সে আমাদের ডাকে সাড়া দেবে! তবে এটা কোন যাদু নয়, বিজ্ঞান।
আমরা যদি খালবিল-জলাভ‚মি ভরাট করে রাস্তাঘাট নির্মাণ করি, এতে পশু-পাখির ক্ষতি কি? কিন্তু খালবিল-জলাভ‚মি ও পশু-পাখিকে দরকার আমাদের অস্তিত্বের জন্যই। আমাদের এমনভাবে উন্নয়ন করতে হবে, যেখানে সবার লাভ হয়। আর প্রকৃতির এই রসায়ন পাঠ করার দক্ষতাও মানুষকে দান করা হয়েছে। কেন আমরা মাথা খাটাবো না?
লেখক-আহমদ গিয়াস, ২৪ জুন, ২০২২