সোমবার, ২০ জানুয়ারী ২০২৫, ০১:৪৬ পূর্বাহ্ন
আলোকিত কক্সবাজার ডেক্স
বাংলাদেশের বিনিয়োগ নীতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উদার, এখানে আইন করে বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস সফরকালে দ্য হেগ-এ হোটেল আমরাথ কুরহাসে বৃহস্পতিবার (৫ নভেম্বর) সকালে দেশটির শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আয়োজিত এক সেমিনারে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এসময় প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন, নেদারল্যান্ডসই ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে ১৯৭২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। তিনি বলেন, সেই তখন থেকেই বাংলাদেশের উন্নয়ন ও বাণিজ্যে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রেখে চলছে দেশটি। আর সাম্প্রতিক সময়ে দু’দেশের উচ্চ পর্যায়ে বেশ কয়েকটি সফর বিনিময়ের মধ্য দিয়ে সে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় উঠে এসেছে।
ইতিহাসের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, সেই ১৬০২ সালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে মসলা দিয়ে বাণিজ্য শুরু হয়, আর পরিবর্তিত পরিস্থিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়েও ডাচ কোম্পানিগুলো বাংলাদেশ বাণিজ্য অব্যাহত রাখে। বর্তমানে বাংলাদেশে ডাচ বিনিয়োগকারীদের ৬৮৪ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ রয়েছে উল্লেখ করে তিনি জানান, ইউনিলিভার, ফিলিপস, ওরগাননসহ ৩০ ডাচ কোম্পানি বাংলাদেশে বিনিয়োগ করছে।
২০০৯ সালে তার সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর দেশের জিডিপি ৬ দশমিক ২ শতাংশ হারে বাড়ছে, রপ্তানি আয় ৩২ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে, রেমিট্যান্স দ্বিগুন বেড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার আর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে বলেও ডাচ ব্যবসায়ীদের সামনে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। ক্রয়ক্ষমতার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের ৩৭তম বৃহৎ অর্থনীতি উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের অর্থনীতি বিশ্বের এখন সবচেয়ে দ্রুত অগ্রসরমান পাঁচটি অর্থনীতির একটি।
তিনি আরও জানান, গোল্ডম্যান সাচস বাংলাদেশকে পরবর্তী শ্রেষ্ঠ ১১ অর্থনীতির একটি এবং জেপি মরগ্যান বাংলাদেশকে উদীয়মান সেরা ৫ এর একটি অর্থনীতি বলেও উল্লেখ করছে।
দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, খাদ্য নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী, মানবাধিকারসহ অন্যান্য দিকে বাংলাদেশের অর্জন তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব কারণে গোটা বিশ্বের কাছে বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের রোল মডেল।
দেশের কৃষি ও শিল্পোন্নয়নে প্রযুক্তির ব্যবহারে বাংলাদেশের অগ্রগতির কথাও ব্যবসায়ীদের সামনে তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে আরও বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বিনিয়োগ নীতি দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে উদার। আমরা আইন করে বিদেশি বিনিয়োগকে সুরক্ষা দিচ্ছি, কর অবকাশ দিচ্ছি, মেশিনারি আমদানিতে থাকছে শুল্ক ছাড়, রেমিট্যান্স রয়্যালটিসহ অন্যান্য সুবিধা থাকছে। যার মধ্যে রয়েছে স্বল্প মজুরিতে পরিশ্রমি তরুণ শ্রমগোষ্ঠী, স্বল্প খরচে ব্যবসা চালু করার সুযোগ। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ভারত, জাপান ও নিউজিল্যান্ডের বাজারে কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তৈরি পোশাক খাতে দেশের ব্যাপক উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারী দেশ। এই শিল্পের চল্লিশ লাখ শ্রমিকের ৯০ শতাংশই নারী। আর এই কর্মসংস্থান নারীদের উদার ও প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণার করে গড়ে তুলছে। তৈরি পোশাক খাতে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা, উন্নত মজুরি ও কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
এছাড়াও তার বক্তৃতায় ওষুধ শিল্প, জাহাজ নির্মাণ, তথ্য প্রযুক্তি খাত গুরুত্ব পায়। প্রধানমন্ত্রী জানান, আইটি সেবায় গন্তব্য দেশ হিসেবে এখন বিশ্বের প্রথম সারির ত্রিশটি দেশের মধ্যে একটি বাংলাদেশ। প্রতি বছর অন্তত ২০ হাজার আইটি গ্রাজুয়েট এই খাতে যুক্ত হচ্ছেন। আর অল্পমূল্যে ওষুধ উৎপাদনেও বাংলাদেশ একটি বড় হাবে পরিণত হয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। জাহাজ নির্মাণে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে। ২০০ বিলিয়ন বৈশ্বিক বাজারের এক শতাংশের হিস্যা বাংলাদেশের, বলেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশে বস্ত্র, চামড়া, রাসায়নিক, ওষুধ, সিরামিক, জাহাজনির্মাণ, টেলিযোগাযোগ, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, প্ল্যাস্টিক সামগ্রী, হালকা প্রকৌশল ও ইলেক্ট্রনিক্স সামগ্রী, তথ্য প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ আরও বিভিন্ন খাতে নেদারল্যান্ডসের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ করার আহ্বান জানান।
বাংলাদেশের ৮টি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এগুলো শতভাগ রপ্তানি পণ্য উৎপাদনের জন্য বরাদ্দ রয়েছে। একটি শিল্পোন্নত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন নতুন অর্থনৈতিক জোন তৈরির কাজ সরকার চালিয়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
যে কেউ চাইলে, আসুন জোনগুলো নিজেদের মতো করে তৈরি করে নিন, বাণিজ্য করুন- বিনিয়োগকারীদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে তার সরকারের ভিশন ২০২১ এর কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ২০২১ সালের মধ্যেই আমরা একটি ডিজিটালাইড, জ্ঞানভিত্তিক মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হতে চলেছি। আর ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি।
ডাচ বিনিয়োগকারীদের আবারও বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আসুন, একসঙ্গে কাজ করতে আমরা কোটি মানুষের ভাগ্য বদলে ভূমিকা রাখি।
বক্তব্য শেষে প্রধানমন্ত্রী প্রায় ২৫ মিনিটের প্রাণবন্ত প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন। এতে নেদারল্যান্ডসের বেশ কয়েকজন প্রতিনিধি প্রধানমন্ত্রীকে প্রশ্ন করেন। প্রধানমন্ত্রী সেসব প্রশ্নের খোলামেলা জবাব দেন।
জলবায়ু বিষয়ক এক প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হই আমরা। কিন্তু বাংলাদেশ এর জন্য দায়ী নয়।
জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট সমস্যা সমাধানে দায়ী দেশগুলোসহ অন্যদেরও আন্তরিক হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় বাংলাদেশের বিভিন্ন সাফল্য ও উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা সবচেয়ে পরিষ্কার ও পরিবেশেবান্ধব জ্বালানি। বাংলাদেশ সৌরবিদ্যুৎকে গুরুত্ব দিচ্ছে।
এ সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ আগামী ৫ বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন লক্ষ্য মাত্রার কথা জানান।
বাংলাদেশে শিক্ষায় উন্নয়নে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী একজনের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে চাই। এক্ষেত্রে সরকার শিক্ষাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। কারণ দারিদ্র্য বিমোচনে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই।
পররাষ্ট্র সচিব শহিদুল হকের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরও বক্তব্য রাখেন- নেদারল্যান্ডসের সাবেক কৃষিমন্ত্রী সিস ভারম্যান, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দলের প্রধান মার্টেন ভারব্রুগেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত নেদারল্যান্ডসের রাষ্ট্রদূত লিওনি কিউলেনাইরা।
সেমিনারে এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগের সুযোগ ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আবুল কালাম আজাদ ‘কেন বাংলাদেশ বিনিয়োগ গন্তব্য?’ বিষয়ে একটি লিখিত বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
সেমিনারে সমাপনী বক্তব্য দেন সিনিয়র সচিব (বাণিজ্য মন্ত্রণালয়) হেদায়েত উল্লাহ আল মামুন। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন পানি সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম।
সেমিনার শেষে প্রধানমন্ত্রী ‘টমেটো ওর্য়াল্ড’ পরিদর্শনে যান। বিকেলে তিনি বাংলাদেশি প্রবাসীদের একটি নাগরিক সংবর্ধনায় যোগ দেবেন।
মন্তব্য করুন