মঙ্গলবার, ২৫ মার্চ ২০২৫, ০৪:০৩ অপরাহ্ন
আলোকিত কক্সবাজার ডেক্স:
জাতিসংঘের সদস্যদেশগুলো গত ৩ আগস্ট টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ২০১৫ পরবর্তী চূড়ান্ত আন্তসরকার সমঝোতায় পৌঁছায়। আলোচনার ফলাফল হিসেবে তারা ‘আমাদের পৃথিবীর রূপান্তর: টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০’ শীর্ষক প্রতিবেদন তৈরি করে। চূড়ান্ত এই সমঝোতা ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য নিউইয়র্কে অনুষ্ঠেয় জাতিসংঘের সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ২৫ সেপ্টেম্বর এই সম্মেলন শুরু হবে।
নতুন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় দারিদ্র্য বিমোচন ও পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি জেন্ডার সমতা ও নারীর ক্ষমতায়নের অঙ্গীকার করা হয়েছে। জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ওই অঙ্গীকার বিশ্বের নারী ও মেয়েদের কণ্ঠেরই প্রতিফলন। তাদের দাবি, প্রত্যেক নারী ও মেয়ের বৈষম্যমুক্ত ও স্বাধীন জীবনযাপনের সুযোগ থাকা উচিত। পাশাপাশি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য এবং এসবের অধিকার বিষয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকারও তাদের রয়েছে।
জেন্ডার সমতার বিষয়টি ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি প্রস্তাবেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে এটি করেছিল। নতুন এসডিজি এবং লক্ষ্যমাত্রাগুলো বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি দেশে নারীর ওপর সহিংসতা, বাল্যবিবাহ, মাতৃমৃত্যু ও অন্যান্য প্রথাগত ক্ষতিকর বিষয়গুলো দূর করা দরকার। তাহলেই নারী ও মেয়েদের নিজ শরীর, পরিবার ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারার বিষয়টি নিশ্চিত হবে। নতুন উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়িত হলে বহু নারী ও মেয়ের জীবন বদলে এবং বেঁচে যেতে পারে।
জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) সাম্প্রতিক জনসংখ্যাতাত্ত্বিক প্রভাব গবেষণা (২০১৫) অনুযায়ী, বাংলাদেশের জনসংখ্যা ২০৩১ সাল নাগাদ ১৯ কোটিতে পৌঁছাবে। আর ২০৪০ সালের আগেই এ সংখ্যা ২০ কোটি হবে। এর মানে হলো, এ দেশে নারীর সংখ্যা হবে ১০ কোটি। তারা দেশের মানব মূলধন ভিত্তির অর্ধেকের প্রতিনিধিত্ব করে এবং প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়তা করে।
বিভিন্ন ঘটনায় এটা অত্যন্ত স্পষ্ট যে যখন কোনো দেশের নারী ও মেয়েরা বৈষম্য ও অন্যায়ের শিকার হয়,তখন তাদের দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক উন্নয়নের গতিও কমে যায়। অন্যদিকে নারীদের যখন সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়; তখন পুরুষ, ছেলেসহ সব নাগরিকই সুবিধাপ্রাপ্ত হয়। নারীরা একটি শক্তিশালী দেশ, স্থিতিশীল সমাজ ও পরিবারের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।
তবু এ দেশে নারী ও মেয়েরা এখনো বিভিন্ন বাধা ও সহিংসতার শিকার হচ্ছে। এসব কারণে তাদের সম্ভাবনাগুলো অপূর্ণ রয়ে যাচ্ছে এবং মানবাধিকার ও স্বাধীনতা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছে। যেমন ২০১১ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর নারীর প্রতি সহিংসতা শীর্ষক এক জরিপে দেখা যায়, ৮৭ শতাংশ বিবাহিত নারী কোনো না কোনো সময় স্বামীর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ নারী শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়েছেন। বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের ব্যাপকতা বিশ্বে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। জাতিসংঘ শিশু তহবিলের (ইউনিসেফ) সহায়তায় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ২০১২-১৩ সালে এক জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৬২ দশমিক ৮ শতাংশ নারী ১৮ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসেছেন।
তা ছাড়া সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ এখনো খুব কম। শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণের হার ৬০ শতাংশ (বিশ্বব্যাংক, ২০১৩)। এটি পুরুষের চেয়ে প্রায় ৩০ শতাংশ কম। আর একই কাজের জন্য নারীদের পুরুষের তুলনায় কম মজুরি দেওয়ার প্রবণতাও বেশি। আবার নারীদের তুলনামূলক কম নিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়। অনেক সময় তাঁরা এমন সব শ্রমে নিয়োজিত থাকেন, যেখানে কোনো ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা বা শ্রমিক অধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকে না। আবার সংসদেও নারীর প্রতিনিধিত্ব তুলনামূলক কম। সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে এবং বেসরকারি খাতের জ্যেষ্ঠ ব্যবস্থাপনা পদগুলোতেও নারীর উপস্থিতি পুরুষের চেয়ে কম।
জেন্ডার সমতা, নারীর ওপর সহিংসতা প্রতিরোধ ও নারীর উন্নয়নের জন্য বেশ কয়েকটি নীতি ও আইন প্রণয়ন করেছে বাংলােদশ। যেমন: যৌন হয়রানি বন্ধে হাইকোর্টের নীতিমালা (২০০৯), পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন (২০১০), নারী উন্নয়ননীতি (২০১১), নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে কর্মপরিকল্পনা (২০১৩) ইত্যাদি। তবে এসব নীতিমালা ও আইন যখন সত্যিকার অর্থে প্রয়োগ করা হবে, কেবল তখনই সেগুলো নারী ও মেয়েদের জীবন রক্ষা করতে ও বদলে দিতে পারবে। তা ছাড়া জেন্ডারবিষয়ক সমস্যাগুলো অত্যন্ত জটিল ও বহুমাত্রিক। তাই সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে সমন্বয় তৈরি করা, বিশেষ করে আন্তমন্ত্রণালয় এবং কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রাগুলো আগামী ১৫ বছর পর আমাদের অবস্থা কেমন হবে, সে সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। ২০৩০ সালে যদি ২৫ বছর বয়সী একজন বাংলাদেশি নারী সহিংসতা ও নিপীড়নমুক্ত জীবন কাটাতে পারেন, যদি তাঁকে ১৮ বছর বয়স পার হওয়ার আগেই বিয়ে না দেওয়া হয়, যদি তিনি যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্তভাবে পান—২০১৫ সালে ২৫ বছর বয়সী একজন বাংলাদেশি নারীর তুলনায়—তখন এসডিজিগুলোকে সফল বলে গণ্য করা যাবে। তবে সে জন্য আমাদের চারপাশে ১০ বছর বয়সী মেয়েরা—যারা ২০৩০ সালে ২৫ বছর বয়সী নারীতে পরিণত হবে—তারা আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দেখছে আমরা এই পৃথিবী ও সমাজকে তাদের জন্য বেশি বসবাসযোগ্য করে তোলার বিষয়ে কতটা গুরুত্ব দিচ্ছি। লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হচ্ছে; আমাদের এখন সেটা বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে কোনো নারী ও মেয়েই পিছে পড়ে না থাকে।
ইউএনএফপিএর একটি প্রতিবেদন থেকে অনূদিত
মন্তব্য করুন