গ্রামীণফোন গ্রাহকদের কাছ থেকে ‘ইচ্ছেমতো’ টাকা কেটে রাখছে বলেও একাধিক ব্যবহারকারীর অভিযোগ।
ফেইসবুক ব্যবহারকারীদের অনেকেই লিখেছেন, নানাভাবে হয়রানির শিকার হলেও নম্বর পাল্টাতে চান না বলে এখনও তারা গ্রামীণফোন ব্যবহারে ‘বাধ্য হচ্ছেন’।
‘জিপি’কে দেশ থেকে তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন রিপন মিয়া নামের এক ফেইসবুক ব্যবহারকারী। মাইনুল হোসাইন নামের একজন জানিয়েছেন লাইসেন্স বাতিল করার দাবি।
প্রতিষ্ঠানটির হেড অফ এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামালের সঙ্গে যোগাযোগ করে কোনো অভিযোগেরই সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।
তিনি বলেছেন, “গ্রাহকরা কোনো ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হলে আমরা সব সময়ই তার সমাধান করতে চাই। আর এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া।”
‘কলড্রপ: প্রতারণার অভিযোগ গ্রামীণফোনের বিরুদ্ধে’ শিরোনামে বৃহস্পতিবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ভেরিফায়েড ফেইসবুক পেইজে পাঠকদের এই প্রতিক্রিয়া আসে।
হাসনাত মো. রহিম নামের একজন পাঠক লিখেছেন, “তারা ফ্রাংকেনস্টাইন। প্রথম থেকেই এই সিম ব্যবহার করছি, এটি আমার পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, তাই বাদ দিতে পারছি না। আমার মনে হয় বেশিরভাগ গ্রাহক একই কারণে বাদ দিতে পারছে না। তাদের একটা স্বচ্ছতার মধ্যে আনা উচিত, কিন্তু এটি কে করবে?”
রাসেল জেডইএচ, মীর রাহাত ও বিশু ত্রিপুরা নামের অ্যাকাউন্ট থেকে তিন পাঠক তাদের মন্তব্যে জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন গ্রামীণফোন ব্যবহার করলেও ‘গ্রাহক হয়রানির’ কারণে তারা বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
দেশের প্রায় অর্ধেক মোবাইল ফোন ব্যবহারকারীকে সেবা দিয়ে গ্রামীণ ফোন চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে মোট পাঁচ হাজার ১৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে।
এ কোম্পানির ৫ কোটি ৩৯ লাখ গ্রাহকের মধ্যে ৯৫ শতাংশই আট ধরনের প্রি-পেইড প্যাকেজের কোনো একটি ব্যবহার করেন, যার কোনো কোনো অফারে প্রতি মিনিটে এক টাকা ৬৮ পয়সা পর্যন্ত কাটা হয়।আর পোস্টপেইড গ্রাহকদের প্রতি মিনিটে ১ টাকা ২০ পয়সা (তার সঙ্গে ভ্যাট রয়েছে) খরচ করতে হয়, যা অন্য অপারেটরগুলোর তুলনায় বেশি।
নেটওয়ার্কের দুর্বলতার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে গ্রামীণফোনে কথা বলার সময় কলড্রপ অনেক বেড়ে গেছে, যা নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির কাছেও পৌঁছেছে।
এই প্রেক্ষাপটে গ্রামীণফোন কর্তৃপক্ষ গত বছর ১ অক্টোবর থেকে কলড্রপে ক্ষতিপূরণের ঘোষণা দিলেও পরে ‘গ্রাহকদের না জানিয়েই’ তা বন্ধ করে দেয়। ভোক্তা অধিকার কর্মীরা গ্রামীণফোনের এ আচরণকে দেখছেন ‘প্রতারণা’ হিসেবে।
এ বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফেইসবুক পেইজে তানজান হোসেন নামের একজন লিখেছেন, “শুধু কলড্রপ নয়, কোনো অফারের রেট বাড়লে তাও জানানো হয় না।”
গ্রামীণফোন ‘অনেক টাকা চুরি করে’ বলে সরাসরি অভিযোগ করেছেন আরিফ রায়হান নামের এক ফেইসবুক ব্যবহারকারী।
শওকত হোসেন বিদ্যুৎ লিখেছেন, “আগে কলড্রপ হলে ১ মিনিট ফেরত দিত, এখন তাও দেয় না। শুধু নেট ভালো এ কথা বলে দিনের পর দিন গ্রাহকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সরকারও নীরব তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার ব্যাপারে।”
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনের নিচে শুভ্রা কান্তি গুপ্তা নামে একজন পাঠক লিখেছেন, গ্রামীণফোন কলড্রপে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বলার পর ভারতীয়রাও তাদের দেশের অপারেটরদের কাছে ক্ষতিপূরণ চেয়েছিলেন। তারা বুঝতেও পারেননি যে, জিপি ‘চুপচাপ কেটে পড়বে’।এ কে এম মাহবুবুর রহমান নামের এক ফেইসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘মাত্র ৭৭ টাকায় ফ্রি ১ GB ফেইসবুক ইন্টারনেট এবং ১০০ মিনিট। ডায়াল *5000*76#। মেয়াদ ডায়াল দিনসহ ৭ দিন। চলবে ২১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত।’- এই বিজ্ঞাপনে আগ্রহী হয়ে কয়েক দিন আগে তিনি ওই অফার গ্রহণ করেন।
“আমার মোবাইলে ব্যালেন্স ছিল ২১২ টাকা। যতক্ষণ এই ব্যালেন্স ছিল, ততক্ষণ ফেইসবুক ব্যবহার করতে পেরেছি। ফেইসবুক ব্যবহারের বিল কাটা হয়েছে সঞ্চিত ব্যালেন্স থেকে। ব্যালেন্স শেষ, ইন্টারনেট অচল। আমার ইন্টারনেট ব্যালেন্স ১০০১ mb, অথচ আমি ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারছি না। ৮৩ মিনিট ফ্রি টকটাইম থাকা সত্ত্বেও কোনো কল করতে পারছি না। অতএব, সাধু সাবধান।”
ইমরান তালুকদার নামের এক গ্রামীণফোন ব্যবহারকারীর অভিযোগ, তিনি পাঁচ টাকায় ২৫০ এমবি ফেইসবুক প্যাক কিনে চালু করার পর দেখেন, তার মোবাইলে থাকা ৩৮ টাকা ব্যালেন্সের পুরোটাই কেটে রাখা হয়েছে।
রুবেল খান লিখেছেন, “তারা ৩ এমবি এক টাকার কথা বলে নিচ্ছে ১.৩৬ টাকা, অথচ ভ্যাটসহ কাটার কথা ১.১৮ টাকা।”
শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন নামে একজন লিখেছেন, ‘৪৮ টাকা রিচার্জ করলে ৪৮ মিনিট পাওয়া যাবে’ এমন বিজ্ঞাপন দেখে তিনি পরপর ২ দিন রিচার্জ করলেও ওই সুবিধা পাননি।
অলিভার ছদ্মনামে একজন পাঠক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় ‘ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স’ সেবায় ‘জালিয়াতির’ অভিযোগ এনেছেন।
মোবাইলে যথেষ্ট ব্যালেন্স না থাকলে *1010*1# এ ডায়াল করে ১০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত ‘ইমার্জেন্সি ব্যালেন্স’ পাওয়া যাবে বলে গ্রামীণফোনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে। পরবর্তী বিল রিচার্জে ওই টাকা কেটে নেওয়ার কথা।
অলিভার লিখেছেন, “আমার মোবাইলে যখন ৯ টাকা ছিল, তখন গ্রামীণফোন আমাকে কল করতে দেয়নি ‘খুব কম টাকা’ আছে বলে। আবার ‘যথেষ্ট টাকা আছে’ এই যুক্তি দেখিয়ে তারা আমাকে ইমার্জেন্সি ব্যালেন্সের জন্যও নিবন্ধন করতে দেয়নি। মোবাইলে থাকা ওই ৯ টাকা শেষ হওয়ার পর আমি আবারও চেষ্টা করি। কিন্তু ওই সুবিধা আমি পাইনি। অথচ যখন টপ আপ করলাম, তারা সেখান থেকে ৪০ টাকা কেটে নিল।”আহসান হাবিব নামের একজন পাঠক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদনের নিচে মন্তব্যে লিখেছেন, “বড় প্রতারণা হলো ইন্টারনেট নিয়ে। আপনারা খেয়াল করবেন, আমাদের পছন্দ করা কোনো ইন্টারনেট প্যাকেজের যখন মেয়াদ শেষ হয়ে যায় তখন নিজে থেকেই প্রতি কিলোবাইটে পয়সা কাটা শুরু হয়। আমি পুনরায় কোনো ইন্টারনেট প্যাকেজ না চাইলে কেন নিজে থেকেই প্রতি কিলোবাইটে পয়সা কেটে নেবে? আমাদের কষ্টের পয়সার অবশ্যই মূল্য আছে। এর কি কোনো প্রতিকার আছে?”
প্রতিকার চাইতে গ্রামীণফোনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করলেও যে হয়রানির শিকার হতে হয়, সেই অভিজ্ঞতার কথা ফেইসবুকে শেয়ার করেছেন কয়েকজন।
সৈয়দ আতিক হোসেন লিখেছেন, “অকারণে ব্যালেন্স কেটে নিচ্ছে, কাস্টমার কেয়ারে কল দিলে ১০ মিনিটের অধিক সময় অপেক্ষায় রাখছে এবং বলছে, তাদের কাছে ব্যালেন্স কেটে নেওয়ার কোনো এসএমএস আসেনি। বলছে, ‘এক ঘণ্টা পরে কল দিন’। এক ঘণ্টা পরে বলছে, তারা কাটেনি। তাহলে গেল কোথায়?”
মো. শাকিল লিখেছেন, “গ্রামীণ ফোনের এই চোরাকারবারি বন্ধ করা দরকার। কথা বলতে বলতে এক ধরনের মিউজিক বেজে ওঠে, কল কেটে যায়। টাকা তো ঠিকই কাটছে। কাস্টমার কেয়ারে কল করলেও দুই টাকা কাটে; 121 এ কল করুন, ওখানে কল করলে বলে- বাংলা শুনতে 1 চাপুন- এ রকম হাজারো…।”নতুন টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে এই গ্রামীণফোন গ্রাহক বলেন, “এভাবে বদমাইশি করে প্রতিদিন গ্রাহকের কাছ থেকে কোটি টাকা লুটে নিচ্ছে। বর্তমান মাননীয় প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিমকে বলছি, এখন এগুলির দিকে একটু নজর দিন। আমাদের মতো গ্রাহকদের বাঁচান।”
মো. মাহমুদ হোসেন লিখেছেন, “আমি একজন স্টার গ্রাহক। বুঝতেই পারছেন, কত টাকা নিয়েছে। আমার মনে হয় আজ পর্যন্ত যত মিনিট কথা বলেছি, তার চেয়ে তিন গুণ টাকা নিয়েছে।”
গ্রাহকদের এসব অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে টেলিফোনে কোনো বক্তব্য দিতে অস্বীকার করেন গ্রামীণফোনের হেড অফ এক্সটার্নাল কমিউনিকেশনস সৈয়দ তালাত কামাল।পরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ই-মেইলের জবাবে তিনি বলেন, গ্রাহকরা যাতে ‘সেরা অভিজ্ঞতাটা’ পান, সেই চেষ্টা গ্রামীণফোন ‘সব সময় করছে’।
“গতির প্রশ্নে, গ্রাহকদের সেবায় এখনও গ্রামীণফোনই সেরা বলে আমাদের বিশ্বাস,” বলেন তালাত কামাল।
অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “কিছু অভিযোগ এসেছে, কিন্তু বিপুল সংখ্যক গ্রাহক রয়েছেন, যারা আমাদের সেবায় খুবই খুশি।”
গ্রামীণফোনের কলড্রপের পরিমাণ এখনও নিয়ন্ত্রক সংস্থার মানদণ্ডে বেঁধে দেওয়া সীমার ‘অনেক নিচে’ বলে এই কর্মকর্তার দাবি।
মন্তব্য করুন