মঙ্গলবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩৪ অপরাহ্ন
আলোকিত কক্সবাজার ডেক্স॥
নগরীর আগ্রাবাদ থেকে ছেলেকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় এসেছেন নিয়াজ দম্পতি। এক খাঁচার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। একটু খানি উঁকি-ঝুঁকি মেরে তাৎক্ষণিক ছুটছেন অন্য খাঁচার সামনে। যেন কোন কিছুর সন্ধানে নেমেছেন দু’জনই। চোখে-মুখে অস্বস্তি। এভাবে পুরো চিড়িয়াখানা চষে বেড়ালেন। তারপরও স্বস্তির দেখা মেলেনি। মা-বাবার পেছনে ছুটছেন পাঁচ বছরের ছেলে অনিক। তার এক প্রশ্ন বাবা বাঘ কোথায়?
চিড়িখানা থেকে বের হওয়ার সময় মুখোমুখি হয় নিয়াজ দম্পত্তির। বারবার ছেলের একই প্রশ্নে বিরক্তও। জানতে চাইতেই খেঁকিয়ে উঠলেন। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। ‘চিড়িয়াখানায় কি বানরের নাচ দেখতে আসছি?’
পরক্ষণেই বললেন,‘বানর ছাড়াতো আর কিছুই নেই। ছেলে বাঘ দেখতে চেয়েছিল বলে নিয়ে এসেছি। এসে দেখি চিড়িয়াখানায় বাঘই নেই। এটা জানলেতো আর আসতাম না এখানে।’
রোববার সরেজমিন চিড়িয়াখানা পরিদর্শন করে নিয়াজ মোর্শেদের কথার সত্যতা মিলেছে। নেই বাঘের গর্জন। কানে আসে না পাখির কিচিরমিচির শব্দও। তবে কান পাতলেই শুনতে পাবেন নিঃসঙ্গ প্রাণীগুলোর দীর্ঘশ্বাস।
নিম্নবিত্তদের একমাত্র বিনোদন কেন্দ্র চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। বর্তমানে চিড়িয়াখানায় ৬৭ প্রজাতির ৩০৭টি প্রাণি রয়েছে। এরমধ্যে অধিকাংশ পাখি। কিন্তু রেসাস বানর আছে ২৬টি। ২০০৬ সালের পর থেকে সরকারিভাবে কোন প্রাণি পায়নি এ চিড়িয়াখানা।
প্রাণীর মধ্যে রয়েছে দুইটি সিংহী, দুইটি পুরুষ ভাল্লুক, ১৯টি কুমির ছানা, তিনটি কুমির, নয়টি চিত্রা হরিণ, পাঁচটি মায়া হরিণ, ৪টি উল্টোলেজী বানর, উল্লুক একটি, হনুমান একটি, চিতা বিড়াল ৪টি।
চিড়িয়াখানায় ঘুরতে আসা আনোয়ার হোসাইন বাংলানিউজকে বলেন,‘চিড়িয়াখানায় মানুষ ছেলে মেয়েদের নিয়ে আসবে বাঘ, চিতাবাঘ, জেব্রা, জিরাফ এসব দেখানোর জন্য। কিন্তু এর কোনটিই নেই চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায়। পাখি দেখতেতো আর চিড়িয়াখানায় আসা লাগে না। গ্রাম বাংলার যেকোন জায়গায় গেলে হরেক রকমের পাখির দেখা মিলবে।’
সরেজমিন দেখা গেছে, চিড়িয়াখানায় ঢুকতেই পরিচ্ছন্ন চত্বর। ডানপাশে একটু এগুলেই বাঘের খাঁচায় চারটি তিতির। এরপাশের খাঁচায় নিঃসঙ্গ তুর্কী মোরগ। একই ছাদের নিচে অন্যপাশের দুইটি খাঁচায় সঙ্গীহীন দুইটি সিংহী। নির্জীব হয়ে পড়ে আছে।
এরপর সামনে এগুতেই মিঠাপানির কুমিরের খাঁচা। তবে খাঁচার ভেতর চৌবাচ্চায় অপরিচ্ছন্ন পানি। বিপরীত পাশের খাঁচা ভর্তি অজগর। তবে সামনের বড় খাঁচা দুইটি শূন্য উদ্যান। খাঁচাগুলোর এক কোনায় দুইটি সাম্বা হরিণ।
আরেকটু সামনে হাঁটতেই চোখে পড়ে পাখির খাঁচা। খাঁচা ভর্তি পাখি থাকলেও নেই পাখির কিচিরমিচির। একটি খাঁচায় পানকৌড়ি, গো বক, ছোট সাদা বক, কানি বক ও ওয়াক। নির্জীব। খাঁচার মাঝখানে পড়ে আছে ছোট মাছের স্তুপ। পঁচা। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। পাখিগুলো পঁচা মাছগুলোর ধারে-কাছেও যাচ্ছে না।
পাশের খাঁচায় রয়েছে- কবুতর, ময়না, টিয়া, শালিক, বন মোরগ, কোকিল, ঘুঘু, মদনা টিয়া।
সামনে এগুতেই একটি সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। একই ছাদে তিনটি খাঁচা। এক খাঁচায় হলুদ পাহাড়ি কাছিম। আরেক খাঁচায় একটি মাত্র শিয়াল। অন্যটিতে কিছু রাজহাঁস।
পাহাড়ের পাদদেশে শিশুদের খেলাধুলার জন্য কিছু খেলনা সামগ্রী স্থাপন করা হলেও তাও জরাজীর্ণ। পাশে সীমানা দেওয়াল না থাকায় অরক্ষিতও।
চিড়িয়াখানার বামপাশের খাঁচার সারিগুলোর মধ্যে বানরের খাঁচার সামনে লোকজনের ভিড়। বানরের লম্পঝম্প দেখে দুধের সাধ ঘোলে মেটাচ্ছেন দর্শনার্থীরা। প্রাণীর পরিচিতি তুলে ধরে সাইনবোর্ড ঝুলানো নেই কোন খাঁচায়।
চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা পরিচালনা পর্ষদের সদস্য সচিব মোহাম্মদ রুহুল আমীন বাংলানিউজকে বলেন,‘নিজস্ব আয় দিয়ে চলে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানা। সরকারি কোন অনুদান নেই। এটি আরও জরাজীর্ণ ছিল। আমি দায়িত্বে আসার পর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশে চিড়িয়াখানার উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নিই। এরমধ্যে চত্বর নির্মাণ, খাঁচা সংস্কার ও সীমানা প্রাচীর নির্মাণে ৩০লাখ টাকা খরচ করা হয়েছে। আরও ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বাকি সীমানা প্রাচীর, সুন্দর তোরণ ও বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করা হবে।’
তিনি বলেন,‘বিভিন্ন প্রাণীর জন্য বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছে। প্রাণী আনার জন্য আমরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
নিঃসঙ্গ নোভা-শোভা
নোভা ও শোভা। দুইটিই সিংহী। ২০০৫ সালের ১৬ জুন এ চিড়িয়াখানাতেই তাদের জন্ম। তাদের জন্মের কিছু দিন পর তাদের মা ‘লক্ষী’ এবং ২০০৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তাদের বাবা ‘রাজ’ মারা যায়। ২ থেকে ৩ বছর বয়সে সিংহী তরুণী হয়। এখন তাদের বয়স ১১। সঙ্গীর অভাবে বিষণ্ন দিন কাটছে তাদের।
একইভাবে ভাল্লুক, হনুমানসহ আরও অনেকগুলোর প্রাণীর কোন সঙ্গী নেই।
চিড়িয়াখানার চিকিৎসক ডা. শাহাদাত হোসাইন শুভ বাংলানিউজকে বলেন,‘সঙ্গী থাকলে নিঃসঙ্গ প্রাণীগুলো উৎফুল্ল থাকতো। সঙ্গী না থাকায় প্রাণীগুলো নির্জীব পড়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই বিষণ্নতায় ভুগে। সন্ধ্যায় প্রাণীগুলো কান্নার সুরে চিৎকার করে। খুবই কষ্ট লাগে। কিন্তু আমাদের কিছু করার নেই। প্রাণীর জন্য মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন সাফারি পার্কগুলোতে চিঠি দেওয়ার পরও কোন সাড়া মেলেনি।
বাঘহীন চিড়িয়াখানা
২০০৩ সালের জুন মাসে ঢাকা চিড়িয়াখানা থেকে পূর্ণিমা ও চন্দ্র নামে দুটি বাঘকে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় আনা হয়। ২০০৬ সালে পুরুষ বাঘটি (চন্দ্র) অন্ত্রে জটিল রোগের কারণে মারা যায়।
২০১২ সালের ৩০ অক্টোবর ক্যান্সারে ভুগে মারা যায় চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানার শেষ বাঘ ‘পূর্ণিমা’। ওই বছরের ২৬ নভেম্বর পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে দুইটি বাঘ চেয়ে চিঠি দেওয়া হলেও কোন সাড়া মেলেনি।
সূত্র-বাংলা নিউজ
মন্তব্য করুন