আলী রীয়াজ |
কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিষয়ে আলোচনায় প্রকাশিত মতামত থেকে এই রকমের ধারণা জন্মাতে পারে যে বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গি বা উগ্রপন্থীদের যোগাযোগের প্রশ্নই অবান্তর। বাংলাদেশে আইএসের উপস্থিতি নাকচ করতে গিয়ে কেউ কেউ এমন বলছেন, যেন বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গিদের উপস্থিতি বা তৎপরতার কথা এই প্রথম শোনা গেল। এ বক্তব্য যাঁরা দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকে কিছুদিন আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গিদের উপস্থিতি রয়েছে বলেই বলার চেষ্টা করেছেন। সরকারের অবস্থান বদলের সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা যেভাবে এ রকম আশঙ্কাকে নাকচ করে দিচ্ছেন, সেটা উদ্বেগজনক। কেননা, বাংলাদেশে জঙ্গি কার্যক্রমের যে ইতিহাস, তা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বিদেশি জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিদের সম্পর্ক ছিল।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক, দেশি-বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থা, সন্ত্রাসবাদ বিষয়ের সাংবাদিক, নিরাপত্তা নীতিমালা তৈরির সঙ্গে যাঁরা যুক্ত, তাঁদের কাছে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের বিষয়টি প্রায় দুই দশকের পুরোনো। বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনা নব্বইয়ের দশকের কথাই বলবেন। এটাও উল্লেখ করা দরকার যে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদের সূচনার সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বিদেশি সংশ্লিষ্টতা। এ দেশে জঙ্গিবাদের উৎসমুখ বলে যাকে চিহ্নিত করা যায়, সেই হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামীর (হুজি) কার্যত প্রকাশ ঘটেছিল ১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল ঢাকায়, জাতীয় প্রেসক্লাবে।
আফগান মুজাহিদদের কাবুল বিজয়ে উল্লসিত ওই যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশি ‘স্বেচ্ছাসেবী’দের একাংশ সংবাদ সম্মেলন করেছিল সেদিন। সাংগঠনিকভাবে হুজি সংগঠিত হচ্ছিল আরও কয়েক বছর আগ থেকে। পাকিস্তানে হুজির প্রাথমিক রূপ তৈরি হয় ১৯৮০ সালে, কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৮৮ সালে এবং এর প্রসার ঘটে পরবর্তী চার বছরে। এই সময়েই সাংগঠনিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশে বিস্তারের পরিকল্পনা করা হয় এবং তার অংশ হিসেবেই বাংলাদেশে হুজির যাত্রা শুরু। পাকিস্তানে হুজির সংগঠকেরা প্রধানত বাংলাদেশকে ব্যবহার করতে চেয়েছিল রোহিঙ্গাদের লড়াইকে শক্তিশালী করার মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী মিয়ানমারকে অস্থিতিশীল করতে।
বাংলাদেশে হুজির বিস্তার দ্রুততা লাভ করে অভ্যন্তরীণভাবে প্রতিষ্ঠিত জঙ্গি সংগঠন জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) সঙ্গে এর সাংগঠনিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর। জেএমবির প্রতিষ্ঠা ১৯৯৮ সালে, এর নামকরণ হয় ২০০১ সালে। কিন্তু জেএমবি ও হুজির সম্পর্ক গড়ে ওঠার পটভূমি তৈরি হয় জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শায়খ আবদুর রহমান যখন জেএমবি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালের দিকে দেশের কিছু আলেম ও ইসলামপন্থী রাজনীতিবিদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন। সেই সূত্রেই হুজির নেতা মুফতি হান্নানের সঙ্গে আবদুর রহমানের যোগাযোগ। ১৯৯৬ সালের ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়ায় হুজির যে ৪১ জন কর্মী সশস্ত্র অবস্থায় আটক হন, তাঁদের মামলা তদারকির জন্য আবদুর রহমান হুজির প্রতিনিধি হিসেবে সেখানে যান। এই যোগাযোগের পরিণতিতেই হুজি ও জেএমবির মধ্যে সাংগঠনিক সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়।
বাংলাদেশের সম্ভাব্য জঙ্গিদের দেশের বাইরে যোগাযোগ শুরু হয় ১৯৯৭-৯৮ সালে। ভারতীয় নাগরিক আবদুল করিম টুন্ডার সঙ্গে আবদুর রহমানের ১৯৯৬ সালে যোগাযোগ ও সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে ওঠা এ দেশে জঙ্গিবাদের ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক। টুন্ডা পাকিস্তানভিত্তিক লস্কর-ই-তাইয়েবার শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো মনে করে যে ১৯৯৪ সালে টুন্ডা বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তাঁর হাত ধরেই আবদুর রহমান পাকিস্তানে প্রশিক্ষণের জন্য যান এবং মারকাজ আদ দাওয়া ওয়াল ইরশাদ, যা লস্কর-ই-তাইয়েবার উৎস সংগঠন, এর সঙ্গে যুক্ত হন, পরিচিত হন হাফিজ সাঈদের সঙ্গে। ভারতীয় গোয়েন্দারা সব সময় অভিযোগ করে এসেছে যে টুন্ডা বাংলাদেশ থেকে ভারতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ চালিয়েছেন। তারা দাবি করে যে ১৯৯৮ সালে দিল্লিতে আটক দুই বাংলাদেশি জেএমবির সদস্য এবং তাঁরা টুন্ডার মাধ্যমে ভারতে এসেছিলেন। ২০১৩ সালে টুন্ডা আটক হয়ে বর্তমানে ভারতে বিচারাধীন আছেন।
বাংলাদেশে বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের সদস্যদের উপস্থিতির বিষয়টি আমরা আরও জানতে পারি ২০০৮ ও ২০০৯ সালে। আবদুর রউফ দাউদ মার্চেন্ট ও জাহেদ শেখ নামে দুজন ভারতীয় জঙ্গির আটকের ঘটনা ঘটে। ২০০৯ সালের মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় কথিত আরেফ রেজা কমান্ডো ফোর্সের মুফতি ওবায়েদুল্লাহসহ আটক হন মোট ছয়জন, তাঁদের মধ্যে একাধিক সদস্য স্বীকার করেন যে তাঁরা অনেক দিন ধরে বাংলাদেশে বাস করছেন; ওবায়েদুল্লাহ ১৯৯৫ সালে ও হাবিবুল্লাহ ১৯৯৩ সাল থেকে বাংলাদেশে আছেন বলে দাবি করেন। এ সময় তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় জঙ্গিগোষ্ঠীর সম্পর্কের বিষয়টি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য লস্কর-ই-তাইয়েবার উৎসাহ কখনোই হ্রাস পায়নি, আর তারা যে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে আসছে, তা সুবিদিত। ফলে বাংলাদেশের এই জঙ্গিদের সঙ্গে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠনের সম্পর্ক যে অব্যাহত ছিল, সেটা আমরা বুঝতে পারি।
বাংলাদেশে জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে বিদেশি যোগাযোগের আরেকটি পথ হচ্ছে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো, যারা পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে কার্যক্রম চালিয়ে এসেছে। মিয়ানমার সরকারের অন্যায় ও অমানবিক আচরণ রোহিঙ্গাদের লড়াইয়ের ন্যায়সংগত কারণ তৈরি করেছে, কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের ভূমিকা নিরাপত্তার জন্য হয়েছে হুমকি। রোহিঙ্গা যোদ্ধাদের সঙ্গে বাংলাদেশের ইসলামপন্থী জঙ্গিদের যোগাযোগ গড়ে ওঠে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তাদের উপলক্ষ করেই পাকিস্তানের হুজি এ দেশে তাদের কাজ সম্প্রসারণ করছিল।
কিন্তু এই গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র সংগ্রহের জন্য যে কেবল তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক, ধর্মীয় বা আদর্শিকভাবে ঐকমত্য পোষণকারীদের সঙ্গেই কাজ করেছে, তা নয়। এদের হাতে আসা অস্ত্রের এক বড় অংশ এসেছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অস্ত্রের কালোবাজার থেকে। এ ক্ষেত্রে থাইল্যান্ডের গোপন অস্ত্রবাজারগুলো সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু গোপন বাজারই এদের একমাত্র উৎস ছিল না। যেগুলোকে ‘গ্রে মার্কেট’ বা ‘ধূসর বাজার’, অর্থাৎ যেগুলো কোনো কোনো দেশের গোয়েন্দা সংস্থার জ্ঞাতসারে, এমনকি প্রত্যক্ষ সংশ্লিষ্টতার মাধ্যমে, দেশের স্বার্থ বিবেচনায় হস্তান্তরিত হয়, সেগুলোও কাজ করেছে। সাধারণভাবে গ্রে মার্কেটের উদাহরণ হিসেবে দেশে দেশে বিপ্লবী থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদী, সন্ত্রাসী থেকে মাদক পাচারকারীদের হাতে গোয়েন্দাদের অস্ত্র তুলে দেওয়ার কথা উল্লেখ করা যায়।
এই অঞ্চলে মিয়ানমারের ওপর চীনের প্রভাব হ্রাসের জন্য সরকারকে চাপে রাখতে আশির দশকের শেষ পর্যায় থেকে প্রায় দেড় দশক ধরে কারেন গেরিলাদের প্রতি ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল; ভারত তাদের অস্ত্র সরবরাহ করেছে বলেও অভিযোগ আছে। অস্ত্র সংগ্রহের জন্য কারেন গেরিলাদের সঙ্গে রোহিঙ্গারা সহযোগিতা করেছে এবং কক্সবাজারের প্রত্যন্ত উপকূলকে ব্যবহার করা হয়েছে অস্ত্র হস্তান্তরের কেন্দ্র হিসেবে।
১৯৮৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারত মহাসাগরের নারকোনডাম দ্বীপের কাছে একটি এবং তার তিন মাস পরে প্রায় ওই একই এলাকায় আরেকটি—মোট দুটি অবৈধ অস্ত্রের চালান আটকের ঘটনা ঘটে। ভারতের নৌবাহিনীর আটক করা এসব অস্ত্রের চালান আরাকান আর্মি ও কারেন গেরিলাদের জন্য যাচ্ছিল এবং সেগুলোর গন্তব্য ছিল কক্সবাজার। এই অস্ত্র আটক এবং আটককৃত ব্যক্তিদের বিষয়ে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং নৌবাহিনীর মধ্যে সে সময় টানাপোড়েনের সৃষ্টি হয় বলে বিভিন্ন সূত্রে বলা হয়েছে।
কারেনদের সঙ্গে আদর্শিক পার্থক্যকে সরিয়ে রেখে যেমন রোহিঙ্গারা একত্রে কাজ করেছে, ঠিক একইভাবে তাদের সঙ্গে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গেও সম্পর্ক গড়ে ওঠার ঘটনা ঘটেছে। বিস্ময়কর এই যে, ভারতের যেসব জঙ্গিগোষ্ঠী ভারতের উত্তরাঞ্চলে বাঙালি, বিশেষ করে বাঙালি মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়েছে, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের সঙ্গে একত্রে কাজ করার ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা বা বাংলাদেশি ইসলামপন্থী জঙ্গিরা দ্বিধান্বিত হয়নি।
এই ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে জঙ্গিগোষ্ঠী প্রতিষ্ঠিত হলে তারা কেবল আদর্শিক বিবেচনাতেই সহযোগিতা করবে তা নয়, বিভিন্ন বিবেচনায় দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে সহযোগিতার যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে, তাতে অর্থ-অস্ত্র-নিরাপদ আশ্রয় অনেক কিছুই বিনিময় হতে পারে। ফলে সীমান্ত ছাড়িয়ে তাদের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠা অসম্ভব নয়। অস্বীকার করলেই তা অপসৃত হবে না। ফলে জঙ্গিবাদ মোকাবিলার প্রথম বিবেচনা হচ্ছে কী কী কারণে জঙ্গিবাদ বা সহিংস চরমপন্থার অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়, কী কী উপাদান দেশের অভ্যন্তরে জঙ্গিবাদকে আদর্শিকভাবে বা কৌশল হিসেবে গ্রহণযোগ্য করে তোলে, সেগুলোকে চিহ্নিত করা, তার বিরুদ্ধে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।
আলী রীয়াজ: যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের অধ্যাপক।
মন্তব্য করুন