শনিবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৫, ০২:২২ অপরাহ্ন

৪৬ বছরেও কক্সবাজারে সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন বধ্যভূমি

৪৬ বছরেও কক্সবাজারে সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন বধ্যভূমি

অনলাইন বিজ্ঞাপন

ওয়াহিদ রুবেল, কক্সবাজার:
স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও কক্সবাজারে সংরক্ষিত হয়নি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্ন, বধ্যভূমিসহ নানা স্থাপনা। দেশে বারবার সরকার পরিবর্তন হলেও এসবের কোন পরিবর্তন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধেরর চেতনা বিশ্বাসী মানুষ।
এ অবস্থার জন্য প্রশাসনের চরম উদাসীনতা, দায়িত্বহীনতাকে দায়ি করেছেন তারা প্রশাসনের অবজ্ঞা, অযত্ন আর অবহেলার কারণে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে কক্সবাজার জেলার ১২ টি বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়নি।
তবে প্রশাসন বলছে, উদাসীনতা নয়, টাকার অভাবেই সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে না জেলার বধ্যভূমিগুলো।
জানা যায়, বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস আসলে কক্সবাজারে মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য নানা উদ্দোগের কথা জানানো হয় প্রশাসন থেকে। কিন্তু তা কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকে। দৃশ্যত কোন পদক্ষেপ মাঠ পর্যায়ে দেখা যায় না। এতে স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও সংস্কারহীন ও বেদখল হয়ে আছে কক্সবাজারের বধ্য ভূমিগুলো।
তবে সর্বশেষ ২০১৫ সালের ৯ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে জেলার ১২ টি বধ্যভুমি সংরক্ষনের উদ্দ্যোগ নেয়া হয়েছিল বলেে জানানো হয়। তারপর ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে হারিয়ে গেছে দুটি বছর। সংরক্ষনের কোন উদ্দ্যোগই নেয় নি প্রশাসন।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সূত্র জানায়, কক্সবাজার জেলার তিনটি উপজেলায় ১২টি স্থানকে বধ্যভূমি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে কক্সবাজার পৌরসভার কবিতা চত্বর সড়কের ১৬ ইসিবির দপ্তর সংলগ্ন ছয় একর জমি।
মহেশখালীতে ১০টি ও টেকনাফেএকটি বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে এসবের একটিকেও সংরক্ষণ করা হয়নি। উল্টো বেদখল হয়ে গেছে আটটি বধ্যভূমি, চারটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এছাড়া ইতিহাসের পাতা থেকে এসব স্মৃতিচিহ্ন মুছে দিতে চলছে নানা ষড়যন্ত্র।
সরেজমিনে কক্সবাজার শহরের কবিতা চত্বর সড়কের বধ্যভূমি এলাকা পরিদর্শন করে দেখা যায়, বধ্যভূমির পশ্চিমপাশে বাহারছড়া উচ্চ বিদ্যালয়, এর পেছনে শ’দুয়েক রোহিঙ্গা পরিবারের বসতি, এবং জামায়াত নেতা নুরীর ইসলামিয়া মহিলা কামিল মাদ্রাসা। এখানে নির্মাণ করা হয়েছে তিন তলা তিনটি ভবন।এছাড়া রয়েছে একটি মসজিদ, এতিম কমপ্লেক্স নামে একটি তিন তলা ভবন।
 ওই ভবনের সামনে দিয়ে বাংলাদেশ সেনা বাহিনীর ১৬ ইসিবি দপ্তর ও বিমান বাহিনীর ঘাঁটি। বিমান বাহিনীর ঘাঁটির পেছনে রয়েছে ওই পাতকূয়া দু’টি। যেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন ও হত্যা করে ফেলে দেয়া হতো। তবে ময়লা আবর্জনায় ভরাট হয়ে গেছে পাতকূয়া দু’টি।
বীর মুক্তিযোদ্ধা কামাল হোসেন চৌধুরী জানান, ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধ চলাকালীন সময় কক্সবাজার শহরের বাহারছড়া এলাকায় ( বর্তমানে কবিতা চত্বর রোডে) পুরোনো সিভিল রেস্ট হাউসে (বর্তমান ১৬ ইসিবি দপ্তর) পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প স্থাপন করে। এরপর থেকেই সেখানে চলে ধর্ষণ, নির্যাতন, আর খুন। প্রতিদিন রাত পোহালেই দেখা যেতো শেয়াল-কুকুর অসংখ্য নারী পুরুষের মরদেহ নিয়ে টানাটানি করছে।
তিনি ক্ষোভের সাথে আরো জানান, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পরও শহরের বধ্যভূমির ছয় একর জায়গা এখনো মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কাছে হস্তান্তর করা হয়নি।
এ ব্যাপারে বধ্যভূমি চিহ্নিত কমিটির অন্যতম সদস্য প্রবীণ আইনজীবী অ্যাডভোকেট  হাবিবুর রহমান জানান, ১৯৯৭ সালে শহরের বধ্যভূমিটি চিহ্নিত করা হয়। ইসিবি ক্যাম্পের পশ্চিম ও উত্তর পাশের ছয় একর জমিকে। সে সময় বধ্যভূমিকে চিহ্নিত করে চারপাশে বাঁশের বেড়া দেওয়া হয়। কিন্তু ক্ষমতার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বেদখল হয়ে গেছে সেই বধ্যভূমি।
কক্সবাজার মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কনান্ড জেলা শাখার সভাপতি কায়সারুল হক জুয়েল বলেন, একটি মহল মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নকে ধ্বংস করার জন্য স্বাধীনতা পরবর্তীও অপচেষ্টা চালুয়ে গেছে, এখনো তা অব্যাহত রয়েছে। যার ফলে নতুন প্রজন্মের অনেকে প্রকৃত ইতিহাস জানতে পারেনি। আমরা চায় দ্রুত সময়ে মুক্তিযোদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ করা হউক। আর বধ্যভূমিতে যেসব স্থাপনা করা হয়েছে তা উচ্ছেদ করারও দাবি জানাচ্ছি।
কক্সবাজার বধ্যভূমি নামক প্রবন্ধের লেখক সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী জানান, শুধু কক্সবাজার নয়, মহেশখালী উপজেলার ১০টি বধ্যভূমির মধ্যে ছয়টি বধ্যভূমি বেদখল হয়ে গেছে।
বাকি চারটি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে গোরকঘাটা বাজার ও দক্ষিণ হিন্দু পাড়া, ঠাকুরতলা আদিনাথ পাহাড়, হোয়ানক পুইছড়ি, মুন্সির ডেইল, কালারমারছড়া বাজার এলাকার বধ্যভূমি দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে দোকানপাট ও বসতঘর।  একই উপজেলায় অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে বড় মহেশখালী দেবেঙ্গাপাড়া, দেবেঙ্গাপাড়া শ্মশান, পালপাড়া ও কায়স্থপাড়া এলাকার বধ্যভূমি।
তাছাড়া টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স পেছনে নাইটং পাহাড়ের পাদদেশে একটি বধ্যভূমি অরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। এ বধ্যভূমির জমিতে বসতবাড়ি গড়ে উঠেছে।
কক্সবাজার জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফা বলেন, আমরা বরাবরই বধ্যভূমিসহ মুক্তিযোদ্ধের সকল স্মৃতি সংরক্ষণের দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু এখনো তা সংরক্ষণের উদ্দোগ লক্ষ করিনি।
এবার বিজয় মেলার মঞ্চ থেকে জেলা আওয়ামীলীগের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন, বধ্যভূমি, গণকবরসহ নানা স্থাপনা সংরক্ষনের এজেন্ডাটি তুলে ধরা হবে। আমরা মুক্তিযোদ্ধের চেতনা বিশ্বাসী নতুন প্রজন্মের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিতে চায়। তাই তাদের জন্য এসব ইতিহাস তুলে ধারা দরকার।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মো. মাহিদুর রহমান জানান, ১৪ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসনের সম্মেলন কক্ষে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে সত্যি বলতে কি এসব কাজ নানা ব্যস্ততার কারণে শুধু আলোচনাতেই থেকে যায়।
তিনি আরো বলেন, জেলা প্রশাসনের নিজস্ব অর্থায়নে বধ্যভুমি সংরক্ষনের মত বৃহৎ কাজ করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার সরকারী ফান্ড। টাকার অভাবের কারণে মূলত আলোচনাতেই সীমাবদ্ধ থাকছে স্বাধীনতার স্মৃতিচিহ্নের সংরক্ষণ।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
Desing & Developed BY MONTAKIM