প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু,
রামুর বৌদ্ধপল্লী এবং বৌদ্ধ মন্দিরে হামলার তিন বছর পূর্ণ হল ২৯ সেপ্টেম্বর। উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়াতে হামলা হয়েছিল ৩০ সেপ্টেম্বর। ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুতে হামলার পরের দিন ছিল মধুপূর্ণিমা। এবারের মধুপূর্ণিমা ২৮ সেপ্টেম্বর উদযাপিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তরা রামু সহিংসতার তিন বছর পূর্তির দিনে পূর্ণিমার ভরা চাঁদের আলো যেমন পেলেন না, তেমনি তারা এতদিনে পাননি ন্যায়বিচারও।
এই তিন বছরে দেশে আরও অনেক ঘটনা ঘটেছে। তাই ঘটনার নিচে চাপা পড়েছে রামু সহিংসতার মতো সাম্প্রদায়িক ঘটনাও। এই সংস্কৃতি থেকে যেন বের হতে পারছে না বাংলাদেশ।
দায়মুক্তির সংস্কৃতি
সহিংসতার পরের দিন, ৩০ সেপ্টেম্বর তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ডক্টর মহিউদ্দীন খান আলমগীর রামু পরিদর্শন করেন। তিনি ধ্বংসযজ্ঞ নিজের চোখে দেখলেন, আক্রান্তদের সঙ্গে কথা বললেন। ঘটনার তদন্ত না হওয়ার আগে রাজনৈতিক রূপ দেওয়া হতে পারে এই ভাবনা থেকে আমিও এগিয়ে গেলাম। জানালাম, রাতের আঁধারে ঘটনা ঘটেছে, হামলাকারীরা সশস্ত্র ও মারমুখী ছিল, তাই আমরা কেউ তাদের সঙ্গে কথা বলার কিংবা নিকটবর্তী হবার সুযোগ পাইনি। আরও জানালাম, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা ও অসহযোগিতা ছিল স্পষ্ট; চেষ্টা করেও পুলিশের সাড়া পাইনি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অভয় দিলেন, রামুর ঘটনায় পুলিশের গাফিলতি থেকে থাকলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
রামু থেকে ফিরে তিনি সন্ধ্যায় ঢাকার পুরাতন বিমান বন্দরে সংবাদ সম্মেলনে মিডিয়াকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিলেন: রামুর ঘটনা মৌলবাদী গোষ্ঠী ঘটিয়েছে। এতে বিএনপির সাংসদের জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিদেশি মৌলবাদী সংগঠন উসকানি দিয়েছে এতে। তিনি আরও বললেন, পরদিন হামলাকারীদের পরিচয় জানা যাবে।
তিনি তাঁর রামু সফর সফল করলেন।
৮ অক্টোবর, ২০১২ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রামু পরিদর্শনে এলেন। তিনি ভারাক্রান্ত মনে ধ্বংসলীলা পরিদর্শন করলেন। আক্রান্তদের সঙ্গে একান্ত আলাপে মিলিত হলেন। আলাপচারিতা শেষে রামু খিজারী হাই স্কুল মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্তৃক আয়োজিত সম্প্রীতি সমাবেশে যোগ দিলেন। সভায় তাঁর মানবিক আচরণ ও উদার সৌজন্যবোধ মানুষ এখনও ভুলতে পারেনি। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও প্রায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো বললেন: ‘‘আমার স্থানীয় নেতাকর্মীরা রামু সহিংসতা প্রতিরোধে চেষ্টা করেছেন। কিন্তু স্থানীয় বিএনপির একজন সাংসদের উসকানিতে এই ঘটনা ঘটেছে।’’
আমরা বলছি না, বিএনপির অভিযুক্ত উক্ত সাংসদ ধোয়া তুলসী পাতা। তবে রাষ্ট্র সেই সাংসদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারল না কেন? তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ কি ভিত্তিহীন ছিল? নাকি তিনি সরকারের চাইতেও ক্ষমতাবান? তিনি কি আইনের উর্ধ্বে?
আমার বিশ্বাস, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে যে নেতা-কর্মীরা ঘটনা সম্পর্কে বুঝিয়েছেন তারা তাঁর সরলতা কাজে লাগিয়েছেন।
বিএনপিও পুরোদমে মাঠে নেমে গেল। তাদের গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত প্রতিনিধি দল রামুতে এলেন ৬ অক্টোবর। সেই তদন্তে তাঁরা রামুর ঘটনায় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংশ্লিষ্টতা পেয়েছেন মর্মে প্রতিবেদন দাঁড় করালেন। বিএনপির সেই তদন্তের পেছনে অপরাধীদের চিহ্নিত করার চাইতে আওয়ামী লীগের সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করাটা ছিল মূখ্য বিষয়।
১০ নভেম্বর, ২০১২ বিএনপি নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া রামু পরিদর্শনে এলেন। তিনিও ধ্বংসযজ্ঞ দেখে ব্যথিত হলেন। স্থানীয় খিজারী হাই স্কুল মাঠে আয়োজিত জনসভায় বক্তব্য দিলেন। সেথানে চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুসারে রামু সহিংসতার সমস্ত দায়ভার আওয়ামী লীগ ও সরকারের উপর চাপিয়ে দিলেন।
জামায়াত-শিবির কি এতই বোকা! তারাও সাফ জানিয়ে দিল, রামুর ঘটনায় জামায়াত কিংবা শিবির জড়িত নয়। রোহিঙ্গারা ঘটা করে তাদের অবস্থান জানাতে পারেনি। কারণ তারা দেশের অবৈধ নাগরিক। তাই ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে তাদেরকে আড়ালে থাকতে হয়।
রামুর কতিপয় বিশিষ্টজন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দিলেন, এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা, হামলাকারীরা সবাই অপরিচিত ও বহিরাগত। পুলিশের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রামুর ঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশের গাফিলতি ছিল না। তবে এ ঘটনার পর স্থানীয় ওসিকে ২ অক্টোবর ও পুলিশ সুপারকে ১৪ অক্টোবর প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছিল।
দেশে কোনো ঘটনা ঘটলে সত্য মিথ্যা প্রমাণিত হবার আগে থেকেই রাজনৈতিক ‘ব্লেইম গেম’ শুরু হয়ে যায়। তাতে প্রকৃত অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অপরাধ যত জঘন্য হোক না কেন, তা সহসা ঢাকা পড়ে যায়। রামুর বেলায়ও তাই হয়েছে।
বিচারহীনতার সংস্কৃতি
দায়হীনতার সংস্কৃতি থেকে বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রভাবিত বিচার ব্যবস্থায় কোনো ঘটনাকে যদি রাজনৈতিক রূপ দেওয়া যায় তাহলে তা যত ক্ষমার অযোগ্যই হোক না কেন, সুবিচার পাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। মামলা ও তদন্ত হলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধতার মুখে মামলা মাঠে মারা যায়।
২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর রামু উখিয়া পটিয়া ও টেকনাফে বৌদ্ধপল্লী এবং বিহারে সাম্প্রদায়িক হামলার বিপরীতে রামু, উখিয়া ও কক্সবাজার থানায় মোট ১৯ টি মামলা হয়। ১৫ হাজারেরও বেশি সংখ্যক মানুষকে আসামী করা হয়। দীর্ঘ এক বছর সময়ের মধ্যে ২০১৩ সালে পুলিশ আদালতে সব মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে। এর মধ্যে রামুর ৮টি, উখিয়ার ৭টি, টেকনাফে ২টি এবং কক্সবাজার সদরে ২টি মামলা হয়।
রামুর ৮ মামলায় ৩২৮ জনকে আসামী করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও তা থেকে ৩৫ জনকে বাদ দেওয়া হয়। উখিয়ার ৭ মামলায় ১৮৩ জনকে অভিযুক্ত করে অভিযোগপত্র দাখিল করা হলেও বাদ দেওয়া হয় ২০ আসামীকে। কক্সবাজার সদর থানার দুই মামলার ১০৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল হয়, কেউ বাদ যায়নি।
রামু ও উখিয়ার ১৫টি মামলার অভিযোগপত্র থেকে মোট ৫৫ জনকে বাদ দেওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, এই ৫৫ আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র প্রদানের নিভর্রযোগ্য ও পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তাহলে কি এটা বলা যায় যে, তারা সবাই হয়রানির শিকার হয়েছেন? নাকি প্রকৃত আসামীদের শনাক্ত করতে হলে এই ধরনের ঘটনা ঘটতেই পারে?
চলতি বছরের মার্চের প্রথম সপ্তাহে রামুর আট মামলার একটি পুরোপুরি নিস্পত্তি হয়ে গেছে। এই মামলার অভিযুক্ত ৩৮ আসামীকে ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৮৫(৬) ধারায় সবাইকে খালাস প্রদান করা হয়।
২৯ সেপ্টেম্বরের ঘটনা-পরবর্তী রামুতে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পরদিন, ৩০ সেপ্টেম্বর সকাল আনুমানিক ৯টার দিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রামুতে উপস্থিতির সময়ই, রামু থানা থেকে অল্প দূরে অবস্থিত শুধাংশু বড়ুয়ার বাড়িতে হামলা করা হয়। মামলার এজাহারে উল্লেখ আছে, হামলাকারীরা লুটপাট, ভাঙচুর করে নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, ৪ ভরি স্বর্ণ, জাতীয় পরিচয়পত্র ও জরুরি কাগজপত্রসহ মূল্যবান কাপড়-চোপড় চুরি করে নিয়ে যায়। এভাবে ওরা বাদীর ৫ লাখ টাকার ক্ষতিসাধন করে। বাদী শুধাংশুর মতে, তাঁর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
এই শুধাংশুর উপর অনেক বার অবিচার করা হয়েছে। প্রথম অবিচার তো ৩০ সেপ্টেম্বর দিনেদুপুরে প্রশাসনের কড়া নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে তাঁর বাড়িতে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো। দ্বিতীয় অবিচার হল ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা থেকে তাঁকে বাদ দিয়ে। এর ফলে তিনি সরকারি বা বেসরকারি সকল ধরনের সাহায্য ও ত্রাণ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন।
তৃতীয়বার অবিচার করা হয় মামলার বিচার থেকে তাঁকে বঞ্চিত করে। আক্রান্ত হবার পর ২ অক্টোবর, ২০১২ বাদী হয়ে মামলা করেন তিনি যাতে ৩৮ জনকে আসামী করা হয়। প্রায় এগার মাস পর, ২৯ আগস্ট, ২০১৩ পুলিশ ৩৮ জনকে আসামী করে অভিযোগপত্র দাখিল করে। মামলার বিচারকার্য শুরু হয় ২১ ডিসেম্বর, ২০১৪। এ বছরের ৪ মার্চ মামলার রায় প্রদান করা হয়। রায়ে মামলার সকল আসামীকে ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪৫(৬) ধারায় খালাস প্রদান করা হয়।
শুধাংশু বড়ুয়া ঘরে ফিরে আসেন চোখের জল মুছতে মুছতে। সেই থেকে বাড়ি, ভিটে বিক্রি করে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছেন তিনি। স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়ের কিছু হৃদয়বান লোক তাঁকে পাহারাও দিচ্ছেন। স্থানীয় ভূমি অফিসে তাঁর কথা আগাম বলে রেখেছেন যাতে তাঁর জমি বিক্রির রেজিস্ট্রি করা না হয়।
তাঁর দুই ছেলে দেশের বাইরে আছেন। আর দুই ছেলে থাকেন বাড়িতে। ৩০ সেপ্টেম্বর তাদের বাড়িতে যখন হামলা হয়, তখন ছেলে মিঠুন বড়ুয়া ঘর থেকে বের হতে পারেননি। আত্মরক্ষার জন্য তিনি ঘরের মাচার উপর উঠে লুকিয়ে থাকেন। হামলাকারীরা ঘরে আগুন দিতে চাইলে শুধাংশুর স্ত্রী শানু বড়ুয়া হামলাকারীদের হাতেপায়ে ধরেছিলেন। গলেনি তাদের মন। তারপর তিনি ছুটে গেলেন অল্প দূরে থাকা বিজিবির কাছে। বিজিবি সদস্যরা তৎক্ষণাৎ ছুটে এলে হামলাকারীরা তাদের ঘরে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার আগেই ঘর রক্ষা হয়, বেঁচে যান মিঠুন।
এরপর বিজিবি সদস্যদের উপস্থিতিতে মিঠুনকে মেয়েদের পোশাক পরিয়ে ছাতা মাথায় দিয়ে বাসা থেকে বের করে পাশের রামকোট বনাশ্রম বৌদ্ধ বিহারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পুলিশ ও বিজিবির নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাধ্যমে তাকে বিহারাধ্যক্ষ শ্রীমৎ প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরসহ কক্সবাজারের বিজিবি ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়।
শুধাংশু বড়ুয়া এখন বাকি দুই ছেলেকেও দেশে রাখতে চান না। থাকতে চান না নিজেও।
রামুর বৌদ্ধ যুবক উত্তম বড়ুয়াকে রামুর ঘটনার কেন্দ্রস্থলে রেখে অনেক আলোচনা হয়েছে। ঘটনার রাত থেকে আজ পর্যন্ত তার হদিস নেই। তিনি জীবিত না মৃত, দেশে না বাইরে এ কথা আমরা কেউ জানি না। তার স্ত্রীও বলতে পারছেন না আসলে তিনি কোথায়। স্ত্রীর বিশ্বাস, উত্তম আর নেই। তিন বছর ধরে যদি তিনি পালিয়েও থাকতেন তবু পিতা হিসেবে অন্তত তার একমাত্র পুত্রসন্তানের খোঁজ নিতেন।
রাতের আঁধারে উত্তমের পালিয়ে যাওয়ার সময় ঘরে ফেলে যাওয়া তার চার বছরের সন্তানের বয়স এখন সাত। শিশুটি এই কয়েক বছরে তার বাবাকে একবারও ডাকতে পারেনি। পায়নি পিতার আদর-স্নেহ। না খেয়ে থাকতে হয়েছে শিশুটিকে অনেক বার। কারণ উত্তম বড়ুয়া তার পিতা! উত্তমের অল্পবয়সী স্ত্রীও পালিয়ে পালিয়ে বেঁচেছেন অনেক দিন। ঘটনার প্রায় এক বছর পরে এলাকায় ফিরেছেন। কিন্তু অভাব এখন তার নিত্যসঙ্গী। উত্তমের স্ত্রী বলে ত্রাণের এক মুঠো চালও তার ভাগে জুটেনি। উত্তমের অসহায় মায়েরও একই অবস্থা। অশ্রাব্য গালিগালাজ জুটেছে তাঁর ভাগ্যে; করতে হয়েছে হাজতবাস।
উত্তম পবিত্র কোরান অবমাননা করেছেন বলে সংবাদ দ্রুত ছড়ানোর কাজটি করেছেন আবদুল মুক্তাদির। তিনিও রামুর সন্তান। ১০ অক্টোবর, ২০১২ পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। ফারুক নামের যে ব্যক্তির দোকান থেকে প্রচারণা চালানো হয়, পুলিশ তাকেও গ্রেপ্তার করেছে। উত্তমকে পাওয়া গেলে এই তিন জনের জবানবন্দির সূত্র ধরে অনেক দূর এগুনো সম্ভব ছিল। উত্তমের নামে পুলিশ যে মামলাটি করেছে সে মামলায় তিনি ১ নম্বর আসামী। এই ১ নম্বর আসামীর জবানবন্দি খুব প্রয়োজন ছিল।
মামলার হাল
শুধাংশু বড়ুয়ার সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, স্থানীয় চেয়ারম্যানের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি আসামীদের খালাস দিতে আদালতকে অনুরোধ করেন। চেয়ারম্যান তাঁকে বলেছেন, মামলায় যাদেরকে আসামী করা হয়েছে তারা প্রকৃত আসামী নয়, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে বিএনপিকে ভোট দেওয়ায় তাদেরকে আসামী করা হয়েছে। শুধাংশুর কথা, চেয়ারম্যান খুব ভালো মানুষ, তাই তিনি তার কথা রেখেছেন। মামলা থেকে খালাস পেয়ে আসামীরা যাতে তাঁর কোনো ক্ষতি না করতে পারে সে জন্য চেয়ারম্যান আসামীদের কাছ থেকে লিখিত স্ট্যাম্পও নিয়েছেন।
বিচারক বাদী শুধাংশুর কথা অনুযায়ী সকল আসামীকে ফৌজদারি কার্যবিধি ৩৪৫(৬) ধারায় খালাস প্রদান করে রায় দেন। চলতি বছরের ৪ মার্চ এই রায় প্রদানের সঙ্গে সঙ্গেই ফুরিয়ে গেল বিচারের প্রয়োজনীয়তা।
রামুর ৮টি, উখিয়ার ৭টি, টেকনাফের ২টি এবং কক্সবাজার সদরের ২টি মামলার বিপরীতে ২০১৩ পুলিশ আদালতে দাখিল করে। রামুর ৮ মামলার ১টির নিষ্পত্তি হলেও আরও ১৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে রামুর আরও ২টি মামলার বিচারকার্য শুরু হয়েছে। ঘটনার পর পর স্বাক্ষীদের মধ্যে যে গতি ছিল, তিন বছরের ব্যবধানে তাতে দৃশ্যমান ভাটা পড়েছে। সাক্ষীরা এখন সাক্ষ্য দেওয়াটায় বাড়তি ঝামেলা মনে করতেই পারেন। সাক্ষ্যের অভাবে মামলার কী রায় হতে পারে তা তো সবার জানা। এভাবে হয়তো রামু সহিংসতার সব মামলার ন্যায়বিচারের আশা থেকে আমাদের দূরে সরেই যেতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতা ও রাষ্ট্র-বিনির্মাণ
আমরা বিশ্বাস করতে চাইনি যে, রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িকতার লালন করছে, প্রশ্রয় দিচ্ছে। মনে করেছিলাম, ঘটনাটি পূর্ব-পরিকল্পিত হলেও সাধারণ মানুষ হুজুগের বশে সহিংসতায় জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু ক্ষুদ্র হলেও সাম্প্রদায়িক একটি অংশ যে আমাদের দেশে ক্রমশ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এটা বার বার প্রমাণিত। এই সত্য যখন অস্বীকার করা হয়, তখন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে।
অনেকের মতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ক্ষমতায় আছে বলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন, সহিংসতা, লুটপাট ও ভূমিদস্যুতা তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে। এ কথা অস্বীকার করার জো নেই। তবে এই নিয়ে যুক্তি দাঁড় করিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগারও অবকাশ নেই। রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা ন্যায্য অধিকার নিয়ে সবার সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতে চাই। সাম্প্রদায়িক শক্তি কখনও কোনো কালে কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের ভালো করেনি। তবে অবনত মস্তকে সকৃতজ্ঞ চিত্তে এও স্বীকার করছি যে, হামলাকারীরা বাদে দেশের সর্বস্তরের মানুষ জাতি, ধর্ম, দলমতনির্বিশেষে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। আক্রান্তদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে যদি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বুঝানো হয়, সে চেতনা থেকেই হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, পাহাড়ি, বাঙালি, আদিবাসী, জাতি-ধর্মনির্বিশেষে সবাই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মের নামে এক সম্প্রদায়ের মানুষ আরেক সম্প্রদায়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল না। পাকিস্তান বিভক্ত হোক এটা চায়নি এমন একটা বড় অংশ এদেশে আছে। তাদের কেউ প্রকাশ্যে এবং আর কেউ লেবাসধারী। সুযোগ পেলে সবাই একই রূপ ধারণ করে।
স্বাধীন দেশে পরাধীন সংখ্যালঘু
এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা নিজেদেরকে পরাধীন ভাবতে শুরু করেছেন। এটা এখন আর লুকিয়ে রাখার বিষয় নয়। বরং আলোচ্য বিষয় হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি। স্বাধীনতার পর থেকে এদেশের হিন্দু ও বৌদ্ধ সম্প্রদায় (বিশেষ করে পাহাড়ি বৌদ্ধ) নিরবে দেশত্যাগ করে চলেছেন। স্বাধীনতার চার দশকের মধ্যে দেশে জনসংখ্যা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেলেও মূলত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সংখ্যা কমেছে। উল্লেখ্য, পঁচাত্তরের পর থেকে সংখ্যালঘুরা দ্রুত দেশত্যাগ শুরু করেন। ১৯৭১ সালেও এদেশে সংখ্যালঘুদের হার ছিল ২০-২১ ভাগ। বর্তমানে এই হার কমে এখন ৯.৭ শতাংশ।
পরাধীন বাংলাদেশে কোনো না কোনোভাবে তারা টিকে থাকলেও স্বাধীন বাংলায় পারছেন না কেন? এখনও পাকিস্তানি কায়দায় তাদের ঘরবাড়ি পোড়ে কেন? পূজার থালায় রক্তের আলপনা ঝরে, উপাসনালয় পোড়ে, কেন? তাদের ভূমি ও নারী লুটপাট হয়। এরপরও আমরা বিবেকের সঙ্গে আপোস করে বলি: ‘‘আমরা খুব ভালো আছি।’’ এমন কথা বলছি আন্তর্জাতিক সভা, সেমিনার ও সম্মেলনেও।
এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ মুসলমান, এটা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য সমস্যা নয়। সমস্যা হল, আত্মঘাতী ও সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এদেশের অসুস্থ ও সুবিধাভোগী রাজনীতি এখনও ধর্মকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতে সিদ্ধহস্ত। এই দোষারূপের রাজনীতির প্রথম শিকার ধর্মীয় সংখ্যালঘু জনগণ। তাদের প্রতি সবার আগে যত্নশীল হতে হবে রাষ্ট্রকে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, এদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়গুলোর কাছে রাষ্ট্রের অবস্থান এখনও পরিষ্কার নয়। আদিবাসীদের অস্বীকার করা, আক্রান্ত ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ন্যায্য বিচার না পাওয়াসহ রাষ্ট্রের অসম নানা আচরণ তাদের দুর্বলতর করছে।
রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় যদি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় সোচ্চার না হন এবং এই সম্প্রদায়গুলো যদি রাষ্ট্র থেকে সুবিচার না পান তাহলে তারা কোথায় গিয়ে দাঁড়াবেন? রামু সহিংসতা পরবর্তীকালে এক ব্যক্তি বললেন, ‘‘ব্যবসা-বাণিজ্য আর বাড়াব না, বাড়িঘর করব না। জমি, ভিটেমাটি যা আছে বিক্রি করে দুই ছেলেকে বিদেশে পাঠিয়ে দেব। পাঠানোর সময় বলব, মা-বাবা মরে গেলেও দেশে ফিরবে না। এদেশে ভবিষ্যত নেই তোমাদের। এমন কঠিন সময় আসছে যে, তোমরা টিকে থাকতে পারবে না।’’
স্বাধীন বাংলাদেশে কি তাদের এভাবে ভাবার কথা ছিল?
একটি ভাষা টিকে থাকে তার ব্যবহারকারীদের উপর। একটি সম্প্রদায় সুখে-দুঃখে টিকে থাকে তার ভূমির উপর। ভূমিহারা হলে তারা উচ্ছেদ হতে বাধ্য। পার্বত্য অঞ্চলে যারা ভূমির অধিকার হারাচ্ছেন তারা দেশান্তর হয়েছেন, এখনও হচ্ছেন। সমতলে যারা ভূমি হারাচ্ছেন তারাও উচ্ছেদ হবেন। টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ভূমিগ্রাস চলছেই। রামুতে এককালে যে সকল বৌদ্ধ জমিদার ছিলেন তাদের বংশধররা জমিদারি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তারা বিভিন্ন কারণে জমির মালিকানা হারাতে বাধ্য হয়েছেন। এছাড়াও নিজেদের মধ্যে ভ্রাতৃকলহ ও সামাজিক অনৈক্য তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ হবার পথ আরও প্রশস্ত করে দিয়েছে।
তাই স্বাধীনতা-পরবর্তীতে কক্সবাজারের মগ, রাখাইনরা যেভাবে উচ্ছেদ হয়েছেন তেমনি বড়ুয়া বৌদ্ধরাও একই পথে এগুচ্ছেন। সেদিন বেশি দূরে নয়।
ত্রাণ নয়, পরিত্রাণ
ধর্ম ও রাজনীতির নামে যারা সাম্প্রদায়িকতায় মেতে উঠেছে আসলে তারা ধর্ম, রাজনীতি দুটোরই উপকার করে কি? তাহলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের চাইতেও সংখ্যালঘু কিছু দুর্বৃত্তের বিরুদ্ধে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ ও রাষ্ট্র রুখে দাঁড়ায় না কেন? ক্ষতিগ্রস্তদের যেমন ত্রাণ দরকার তার চেয়েও বেশি দরকার পরিত্রাণ। রামুর ঘটনায় ধর্মীয় উস্কানি এতই প্রবল ছিল যে, হাতেগোনা কজন ব্যক্তি ছাড়া কেউ এগিয়ে আসেননি। এমনকি প্রশাসনও নয়। বরং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশার মানুষ ওই হামলায় ভূমিকা রেখেছিলেন। পরে নিজেদের রক্ষা করতে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সাইনবোর্ড কাজে লাগানোর সুযোগ নিয়েছেন।
জাতির পিতা ১৯৭৪ সালের ১৮ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতার একাংশে বলেছিলেন, রাষ্ট্রের চারটি আদর্শ– গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। একই সঙ্গে বলেছিলেন, তাঁর দলেরও চারটি আদর্শ– নেতৃত্ব, মেনিফেস্টো, নিঃস্বার্থ কর্মী ও সংগঠন। দলকে তিনি সমুন্নত রাখতে ও শক্তিশালী করতে দল থেকে আবর্জনা দূর করতে বলেছিলেন। আদর্শ-বিচ্যুতদের তিনি আবর্জনা মনে করতেন। কারণ তারা দলের উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি করে থাকে।
যে কোনো দলে জাতির পিতার বর্ণিত এই আবর্জনার স্তূপ যত উঁচু হবে, দল ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ততই নিচু হবে। তাই অন্তত রাষ্ট্র ও দলের পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির স্বার্থে দল থেকে সুবিধাবাদী, সাম্প্রদায়িক, চাঁদাবাজ, ভূমিদস্যু ও লুটেরাদের বর্জন করতে হবে। এতে দল, সরকার এবং রাষ্ট্রের দায়মুক্তি ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির কলঙ্ক থেকেও মুক্তি পাবে।
রামু সহিংসতা পরবর্তীতে সরকার আক্রান্তদের জন্য যা করেছেন তা অকপটে স্বীকার্য। ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর নির্মাণ, আর্থিক অনুদান, ক্ষতিগ্রস্ত বৌদ্ধ বিহারগুলোর পুনঃনির্মাণ ও সংস্কারকরণ, নিরাপত্তা জোরদারের মতো মানবিক সহযোগিতা দিয়েছেন, এখনও করে যাচ্ছেন। জাতি-ধর্ম ও দলমতনির্বিশেষে যারা সহযোগিতা ও সাহস জুগিয়েছেন তাদের সকলের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা ও শ্রদ্ধা জানাই।
মন্তব্য করুন