শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:০৪ পূর্বাহ্ন

সন্ধ্যা হলে বদলে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

সন্ধ্যা হলে বদলে যায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

অনলাইন বিজ্ঞাপন

ওয়াহিদ রুবেল, কক্সবাজার ১৮ সেপ্টম্বর ১৯ ইং

সন্ধ্যা হলেই বদলে যায় কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর দৃশ্য। ক্যাম্পের অভ্যন্তরে চলে উগ্রবাদি রোহিঙ্গা গোষ্টির সশস্ত্র মহড়া এবং রমরমা মাদক ব্যবসা। তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বললে অপহরণসহ খুন হতে হয়। বলতে গেলে সন্ধ্যার পর রোহিঙ্গা ক্যাম্প চলে অন্য একটি সরকারের অধীনে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন তথ্য নিশ্চিত করেছেন কুতুপালং লম্বাশিয়া ক্যাম্পের রোহিঙ্গারা।

রবিবার রোহিঙ্গাদের সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। তারা জানিয়েছেন, দিনের বেলায় উগ্রবাদি রোহিঙ্গাদের সদস্যরা সাধারণ রোহিঙ্গা বেশে থাকলেও রাতে ভয়ংকর হয়ে উঠে। তাই সহজে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বিপদে পড়তে চাইনা। অনেকটা পুরো রোহিঙ্গা গোষ্টি জিম্মি হয়ে আছে এসব সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্টির কাছে।

রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন, উগ্রবাদি রোহিঙ্গা গোষ্টির কারণে ক্রমই অস্থিরতা বাড়ছে উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সাথে সাথে ৩২টি ক্যাম্পের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রোহিঙ্গাদের উগ্রবাদি সংগঠন কথিত আরসা, আলইয়াকিন, হাকিম বাহিনী ও সদ্য গড়ে উঠা ‘এআরএসপিএইচ’, ‘ভয়েস অব রোহিঙ্গা কমিটি’ এবং ক্যাম্প ভিত্তিক গড়ে উঠা বিভিন্ন গ্রæপের সদস্যদের হাতে। ক্যাম্প নিয়ন্ত্রণ রাখতে অনেক সময় নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে তারা। এতে হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে প্রতিনিয়ত। এ অবস্থায় আতংকে থাকেন সাধারণ রোহিঙ্গারা।

তারা বলেন, প্রত্যাবাসনে বিরোধী কর্মকান্ড এবং ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গা সমাবেশ সফল হওয়ার পেছনে এসব সংগঠন ভ‚মিকা রেখেছে। তারা সাধারণ লোকজনকে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হতে বাধ্য করেছে। যেসব ক্যাম্পের লোকজন উপস্থিত থাকেনি তাদের উপর সমাবেশ পরবর্তী হামলা চালিয়েছে বলেও জানিয়েছেন রোহিঙ্গারা। তবে আলোচিত রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহর নেতৃত্বে থাকা ‘আরকাইন রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস এন্ড হিউম্যান রাইটস (এআরএসপিএইচ)’ সংগঠনটি অন্যন্য সংগঠনের নেতৃত্বে রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন তারা।

রোহিঙ্গাদের একটি দায়িত্বশীল সূত্র দাবি করেছেন, রোহিঙ্গা যুব সমাজ নিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সাপ্তাহিক বৈঠক করেন। এসব বৈঠকে মিয়ানমার সরকার বিরোধী বক্তব্য দেয়া হয়। অনেকটা রোহিঙ্গা যুবকদের প্রতিশোধ পরায়ন করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এছাড়া কুতুপালং এবং নয়াপাড়া শিবিরে পৃথক কয়েকটি আস্তানা রয়েছে যেখানে এসব সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বৈঠক করেন। এছাড়া জুমা’র খোতবার সময় উস্কানিমূলক বক্তব্য প্রদান করেন ইমামরা। কিন্তু বাইর থেকে এসব দৃশ্য কারো চোখে পড়ে না। ক্যাম্পের বাইরে থেকে মনে হবে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে শান্তি বিরাজ করছে, কিন্তু ক্যাম্পের ভেতরের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন।
রোহিঙ্গারা আরো জানান, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনেক রাস্তা দিয়ে সব জায়গায় পৌঁছাও সম্ভব নয়। এছাড়া উঁচু নিচু পাহাড় বেয়ে সহজেই গন্তব্যে যাওয়াও কঠিন। যার ফলে অপরাধ করে সহজেই পার পেয়ে যায় অপরাধীরা।

রোহিঙ্গাদের নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়, মুহিবুল্লার সংগঠন নেতৃত্বে থাকলেও টেকনাফ-উখিয়ার ৩২টি ক্যাম্পেই রাজত্ব করছে মূলত আলইয়াকিন বাহিনীর সদস্যরা। প্রতিটি ক্যাম্পে ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী যুবকদের নিয়ে গড়ে উঠেছে এক একটি গ্রæপ। আর প্রতিটি গ্রæপে থাকে সদস্য থাকে ২৫ থেকে ৩০ জন। নিজেদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলে খুন করতেও চিন্তা করেনা এ সংগঠনের কর্মীরা।

আর্থিক স্বচ্ছলতা নিশ্চিত করতে তারা ইয়াবা ব্যবসা করেন সংগঠনটি। রোহিঙ্গা যুবকদের দিয়ে খুচরা বিক্রির পাশাপাশি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ইয়াবার চালান পৌঁছে দেয়। ইয়াবা পাচারে কেউ অস্বীকৃতি জানালে তাকে হত্যা করা হয়। এছাড়া স্বচ্ছল রোহিঙ্গাদের অপহরণপূর্বক মুক্তিপণ আদায়ের ঘটানা অহরহ। লুট করে নিয়ে যায় স্থানীয়দের গৃহপালিত গরু-ছাগল থেকে শুরু করে মূল্যবান সম্পদও।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের দেয়া তথ্য মতে, গত দুই বছরে টেকনাফ ও উখিয়া ক্যাম্পে ৪২টি হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর বেশির ভাগের সঙ্গেই আলইয়াকিন বাহিনী জড়িত।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলো পাহাড়ে হওয়ায় গভীর জঙ্গলে কিংবা পাহাড়ের চূড়ায় আস্তানা তৈরি করেছে এসব উগ্রবাদি সংগঠন। রোহিঙ্গা যুবকদের ধরে এনে তাদের আস্তানায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। টেকনাফ নয়াপাড়া শালবন এবং লম্বাশিয়ার আরো পশ্চিমে উগ্রবাদিরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্প রয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ফরেস্ট বিভাগ নিয়ে কর্মরত অনেক এনজিও কর্মীরা। এসব ক্যাম্পে নুন্যতম একমাসের প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক সংগঠনের প্রতিটি কর্মীর জন্য। এছাড়া রোহিঙ্গা ক্যাম্পের প্রতিটি মাঝি, দোকানদার, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর নিয়োগকৃত ভলেন্টিয়ার আল ইয়াকিনের হয়ে কাজ করে।

সরকারের প্রতিনিধি বা সিআইসিদের সাথে মাঝিদের যেসব আলাপ আলোচনা হয় তা আল ইয়াকিন সদস্যদের জানিয়ে দেয় তারা। এর ব্যতয় হলেই খুন হতে হয় তাদের। তাই বেঁচে থাকার জন্য গোপনে আল ইয়াকিনসহ বিভিন্ন সংগঠনের হয়ে কাজ করে মাঝিরা।

রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ক্যাম্পের সশস্ত্র গোষ্ঠী একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাই তারা কোন কিছু আমলে না নিয়ে হত্যাসহ যেকোন ধরনের অপরাধ করে। রোহিঙ্গাদের ভাষায় ‘ক্যাম্প দিনের বেলায় বাংলাদেশের আর রাতের বেলায় আল ইয়াকিন। এ খবরটি এখন ওপেন সিক্রেট।”

তাদের দাবি, ক্যাম্পে থাকা সশস্ত্র গোষ্ঠী চায় না রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফিরে যাক। তারা রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে রেখে তাদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে নিতে চাই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ক্যাম্পে কর্মরত স্থানীয় প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ক্যাম্পে থাকা সশস্ত্র রোহিঙ্গা গোষ্টি রোহিঙ্গা যুবকদের প্রতিশোধ পরায়ন করে গড়ে তুলতে চাই। যেন মিয়ানমারের প্রতি হিংসা নিয়ে বড় হয়। সেজন্য তারা বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে পারে। এই আশংকার কথা জানিয়েছে তিনি বলেন, শুরু থেকেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে নিরাপত্তা ও নজরদারি বাড়িয়েছে বাংলাদেশে সরকার।

কক্সবাজারে কর্মরত এনজিও সংস্থার একাধিক কর্মকর্তা জানান, শরণার্থী ক্যাম্পের পরিস্থিতি যেভাবে দিনকে দিন জটিল হয়ে উঠছে এতে ক্যাম্পের ভেতরে নিরাপদে কাজ করা মুশকিল হয়ে পড়ছে। এনজিও কাছ থেকে সাহায্য পায় বলে এখনো রোহিঙ্গারা কিছু বলছে না। কিন্তু একটু এদিকে থেকে ওদিক হলেই তেড়ে আসে এনজিও কর্মীর দিকে। যদি সাহায্যের মাত্রা কমে আসে তাহলে এনজিও কর্মীরা রোহিঙ্গাদের চক্ষুশূলে পরিণত হতে পারে বলে আশংকা প্রকাশ করেছেন তারা।
নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আইনশৃঙ্খলার দিকে তাদের তীক্ষন নজর রয়েছে। কোন রকম অপরাধের সাথে জড়িত থাকার নূন্যতম প্রমাণ পাওয়া গেলেই তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

উখিয়া থানার ওসি আবুল মনসুর বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আলইয়াকিন নামে একটি গ্রুপ সক্রিয় আছে বলে আমরা জেনেছি। প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়াতেও তারা প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছে বলে শুনেছি। ইতোমধ্যে আলইয়াকিনের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে জেলহাজতেও পাঠানো হয়েছে। তারা যাতে সক্রিয় হতে না পারে এজন্য সব ধরনের গোয়েন্দা নজরদারি অব্যাহত আছে।

কক্সবাজার জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) মো: ইকবার হোসেন বলেন, এক সাথে বিশাল এক জনগোষ্টি অলস জীবন যাপন করছে। এতে একটি অংশ হয়তো বিপদগ্রস্ত হতে পারে। কিন্তু আমরা কোন প্রকাশর অপরাধ ছাড় দেবো না। ইতিমধ্যে ক্যাম্পে পুলিশ ক্যাম্প বাড়ানো হয়েছে। পুলিশের সদস্য সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। যেখানে কোন অপরাধের খবর পাচ্ছি সাথে সাথে সেখানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান পরিচালনা করছে। সুতরাং উদ্বিগ্ন হওয়ার কোন কারণ নেই।


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
Desing & Developed BY MONTAKIM