মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:২৩ পূর্বাহ্ন

আবদুল গাফফার চৌধুরী এই কালাকানুন আরও আগে বাতিল হওয়া উচিৎ ছিল

আবদুল গাফফার চৌধুরী এই কালাকানুন আরও আগে বাতিল হওয়া উচিৎ ছিল

অনলাইন বিজ্ঞাপন

Abdul-Gaffar-Choudhury1শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে বিড়ালের গলায় একটি ঘন্টা বাঁধা হয়েছে। অর্থাৎ অকারণ মুষিক-হত্যা বন্ধ করার
একটা ব্যবস্থা হয়েছে। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’ নামে পরিচালিত সরকারি অভিযানটির দায়মুক্তি দিয়ে করা আইনটি হাই কোর্ট ‘সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’ আখ্যা দিয়ে বাতিল ঘোষণা করেছেন। হাই কোর্টের এই রায়ে বলা হয়েছে, যৌথ বাহিনীর ওই অভিযানের সময় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা ফৌজদারি ও দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন এবং হাই কোর্টে রিট আবেদনও করতে পারবেন।

বিএনপি-জামায়াত সরকার যৌথ বাহিনীকে আইনের উর্ধ্বে স্থান দিয়েছিল এবং অকারণ ও অবৈধ হত্যারও দায়মুক্তি দিয়েছিল। সে আমলে মাত্র চার মাসের অভিযানেই অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়। যৌথ বাহিনী দাবি করেছিল, তারা সকলেই হৃদরোগে মারা গেছে। র‌্যাবের হাতেও যত মৃত্যু ঘটেছে তাকে ‘ক্রস ফায়ারিং’এ বলে দাবি করা হয়েছে।

আমার অনেক পাঠকেরই স্মরণ থাকার কথা, বঙ্গবন্ধু সরকারের আমলে সর্বহারা পার্টির সন্ত্রাসী নেতা সিরাজ শিকদার পুলিশের অভিযানে বন্দি হওয়ার পর মারা যান। একে ‘বিচার-বহির্ভূত হত্যা’ আখ্যা দিয়ে সারাদেশে হৈ চৈ পড়ে গিয়েছিল। এখনও বঙ্গবন্ধু সরকারকে সমালোচনা করার জন্য সিরাজ শিকদারের হত্যাকাণ্ডটি বড় করে সামনে তুলে আনা হয়।

সে আমলে মাত্র চার মাসের অভিযানেই অর্ধশতাধিক মানুষের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয়

পরবর্তীকালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সর্বহারা পার্টিতে সিরাজ শিকদারের স্থলাভিষিক্ত নেতাকেও পুলিশি অভিযানে হত্যা করা হয়। তা নিয়ে দেশে কোনো হৈ চৈ হয়নি। ফলে বুঝতে কষ্ট হয়নি সিরাজ শিকাদরের হত্যাকাণ্ড নিয়ে হৈ চৈ ছিল রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। বিচার-বহির্ভূত হত্যার প্রতিবাদ তার মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না।

বিএনপি সরকারের আমলে যখন র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ন, র‌্যাব গঠিত হয় এবং তাদের হাতে সন্ত্রাসী-অসন্ত্রাসী নির্বিশেষে অনেকের মৃত্যুর ঘটনা ‘ক্রসফায়ারিংয়ে মৃত্যু’ বলে দাবি করা হয়, তখন তা নিয়ে দেশে বড় একটা হৈ চৈ ওঠেনি। অনেকেই তখন এই ভেবে একে মেনে নিয়েছিলেন যে, দেশে যেভাবে সন্ত্রাসের বাড়াবাড়ি ঘটেছে, তাতে এই ব্যবস্থা যত অমানবিক হোক, তার দরকার আছে। আওয়ামী লীগও বিরোধী দলে থাকাকালে র‌্যাব গঠন বা ক্রসফায়ারিংয়ে মৃত্যুর জোরেসোরে প্রতিবাদ করেনি। বরং ২০০৮ সালে তারা ক্ষমতায় আসার পরও র‌্যাব লুপ্ত করা হয়নি বা তাদের অপারেশনগুলো দায়মুক্ত ঘোষণার আইনটি (২০০৩) বাতিল করা হয়নি।

বিএনপি আমলের যৌথ অভিযানের দায়মুক্তি আইনের (২০০৩) বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১২ সালের ১৪ জুন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জেড আই খান পান্না হাই কোর্টে রিট আবেদন করেন। এই আবেদনের শুনানি শেষেই গত ১৩ সেপ্টেম্বর অপারেশন ক্লিন হার্টের দায়মুক্তি অবৈধ ঘোষণা করেন হাই কোর্ট। বিএনপি আমলের দায়মুক্তি আইনে বলা হয়েছিল, ‘‘অভিযানে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বা মারা গেলেও কোনো আদালতে প্রতিকার চাওয়া যাবে না।’’

এটা ছিল সংবিধান-পরিপন্থী কালো আইন। তার উপর ১৯৯৮ সালে বাংলাদেশ যে নির্যাতন-বিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনশনে সই করেছে তারও বিরোধী।

এই আবেদনের শুনানি শেষেই গত ১৩ সেপ্টেম্বর অপারেশন ক্লিন হার্টের দায়মুক্তি অবৈধ ঘোষণা করেন হাই কোর্ট

রিট আবেদনকারী যথার্থই বলেছেন: “মানুষ নির্যাতিত হবে, খুন হবে, কিন্তু প্রতিকার চাওয়া যাবে না– এর চেয়ে কালো ও খারাপ আইন আর কিছু হতে পারে না। বিচার-বহির্ভূত যে কোনো হত্যাকাণ্ড আইনের শাসনের পরিপন্থী।”

এই সম্পর্কে হাই কোর্টের রায়ের পর ডেপুটি এটর্নি জেনারেল বলেছেন:

“তৎকালীন (বিএনপি সরকারের আমলের) সংসদ দায়মুক্তির একটা আইন পাশ করেছিল। যার কারণে ওই সময় কেউ কোর্টের আশ্রয় নিতে পারেনি বা থানায় গিয়েও মামলা করতে পারেনি।”

ডেপুটি এটর্নি জেনারেলের এই বক্তব্যের পরও একটি প্রশ্ন থেকে যায়, ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে কেন দায়মুক্তির এই কালো আইন বাতিল করার পদক্ষেপ নেয়নি? আওয়ামী লীগের বর্তমান শাসনামলে ‘ক্রস ফায়ারিং’ বা ‘হার্ট অ্যাটাকে’ মৃত্যুর ঘটনা হ্রাস পেলেও একেবারে বন্ধ হয়নি।

আওয়ামী লীগের এক নেতৃস্থানীয় বন্ধুকে আমি জিজ্ঞাসা করেছি, তারা দায়মুক্তির এই আইন কেন এত দিন জিইয়ে রেখেছেন? তিনি নানা অসুবিধার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সরকারেরও ইচ্ছা ছিল এই আইন যাতে বাতিল হয়। আমি তাকে বলেছি, দেশে সন্ত্রাস দমনের জন্য অপারেশন ক্লিন হার্টের মতো অপারেশন অবশ্যই চলতে পারে। কিন্তু এই অপারেশন চলাকালে ক্ষমতা-বহির্ভূত কাজের দায়মুক্তি দেওয়া একটি সভ্য দেশে কিছুতেই উচিৎ নয়। তাতে অপরাধ দমনের চাইতে নতুন অপরাধ তৈরি হয়, যা ঘোরতরভাবে মানবতাবিরোধী।

তিনি বললেন, বিএনপি দীর্ঘকাল ক্ষমতায় থাকার সময় জাতির পিতার হত্যাকারীদের দায়মুক্তির (ইনডেমনিটি) অধ্যাদেশটি পর্যন্ত বাতিল করেনি। বরং বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সুরক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছে। এই ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল এবং ঘাতকদের বিচার করার জন্যও আওয়ামী লীগকে দীর্ঘকাল অপেক্ষা করতে হয়েছে। ‘অপারেশন ক্লিন হার্টের’ অভিযানের দায়মুক্তি দেওয়ার আইনটি সংসদ বাতিল করতে গেলে দেশে অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারত। কারণ, দেশে এই সেদিনও সামাজিক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস তুঙ্গে ছিল। যদিও সন্ত্রাস দমনে যৌথ বাহিনীর অভিযান অনেক সময় বৈধতার সীমা লঙ্ঘন করেছে, কিন্তু একটা সময় এই অভিযান সাধারণ মানুষের মনে স্বস্তি এনে দিয়েছিল।

অপারেশন অবশ্যই চলতে পারে, কিন্তু অপারেশন চলাকালে ক্ষমতা-বহির্ভূত কাজের দায়মুক্তি দেওয়া সভ্য দেশে কিছুতেই উচিৎ নয়

এই মন্তব্য আংশিকভাবে সঠিক। দেশে এক সময় সন্ত্রাসের কাছে নাগরিক জীবন এমনভাবে জিম্মি হয়ে পড়েছিল যে, র‌্যাব গঠন এবং অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে পরিচালিত অভিযান অনেকের মনেই স্বস্তি এনেছিল। এই স্বস্তি ঘুচতে শুরু করল যখন অভিযোগ ওঠে, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কিছু নির্দোষ বা সন্দেহভাজন মানুষও এই অপারেশনের নিষ্ঠুরতার বলি হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিরা সকলেই ক্রসফায়ারিংয়ে মারা গেছে, অথবা হৃদরোগে মারা গেছে এই ঢালাও দাবি সাধারণ মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে থাকে। পরে তা জনমনে স্বস্তির বদলে অস্বস্তির সৃষ্টি করে।

একজন আইনজীবী বলেছেন, “আদালতের কথা হল, যে যত বড় অপরাধই করুক না কেন, পুলিশ বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাজ হল, তাকে গ্রেপ্তার করে তদন্ত ও জিজ্ঞাসাবাদের পর মামলা দায়ের করে বিচার করা। জিজ্ঞাসাবাদের নামে হেফাজতে নিয়ে তাকে যে নির্যাতন করা হয়, সেটা সম্পূর্ণ বেআইনি এবং এই বেআইনি কাজ করার ক্ষমতা বা এখতিয়ার সংবিধান কাউকে দেয়নি।”

আদালতের এই বক্তব্য সাধারণভাবে সকলেই মানেন। কিন্তু পরিস্থিতির ভিন্নতায় কোনো কোনো আইনজীবী মহলে অন্য কথাও শোনা যায়। তারা বলেন, সঙ্ঘবদ্ধ সন্ত্রাসীরা যখন রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে, তখন রাষ্ট্রের নিয়ামিত প্রহরীরা সম্মুখযুদ্ধে তাদের হত্যা করলে দোষের কিছু নেই। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধেও এক পক্ষ আরেক পক্ষ বা শত্রুপক্ষের সৈন্য নির্বিচারে হত্যা করলে তা বেআইনি হয় না। এখানে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নটি বড়।

এই যুক্তি দেখিয়ে ভারতে মাওবাদী ও নকশালপন্থী সন্ত্রাসীদের নির্বিচারে হত্যা করা আইনি কাজ বলে অনেক সময় বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে সশস্ত্র পন্থায় রাষ্ট্রের কর্তৃত্ব দখলের চেষ্টা করেছিল। দেশের সেনাবাহিনী ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যুদ্ধ করে তাদের দমন করেছে। এই যুদ্ধে শত্রুহত্যা বেআইনি হয়নি।

এই যুক্তির প্রতিবাদে ভারতের মানবিক অধিকার রক্ষা আন্দোলনের এক নেতা তখন বলেছিলেন, ‘‘সম্মুখযুদ্ধে শত্রু-সৈন্য হত্যার মতো সশস্ত্র বন্ত্রাসী হত্যাও অবৈধ নয়। কিন্তু অবৈধ কাজ হল, শত্রুপক্ষের সৈন্য বা সন্ত্রাসী কেউ ধরা পড়লে এবং বন্দি হওয়ার পর যদি তাকে নির্যাতন করে হত্যা করা হয় এবং এই হত্যাকাণ্ড চাপা দেওয়ার জন্য এই মৃত্যুর ‘অসত্য’ কারণ দর্শানো হয়। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীও বন্দি অথবা আত্মসমর্পণকারী শত্রু-সৈন্য হত্যা সম্পূর্ণ অবৈধ ও গর্হিত কাজ।’’

অবৈধ কাজ হল, শত্রুপক্ষের সৈন্য বা সন্ত্রাসী কেউ বন্দি হওয়ার পর যদি তাকে নির্যাতন করে হত্যা করাহয়

বাংলাদেশে বিএনপির প্রবর্তিত অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে পরিচালিত যৌথ বাহিনীর অভিযানটির দায়মুক্তি দানের আইন দেশের মানুষ এ জন্যেই গ্রহণ করতে পারেনি যে, এই অভিযানে ক্ষমতার অপব্যবহার ও বৈধতার সীমা অতিক্রমের অভিযোগ ক্রমেই বাড়ছিল। অনেকেই সন্দেহ করেন, সন্ত্রাসী হিসেবে বহু লোক ক্রসফায়ারে বা হৃদরোগে মারা যায়নি। কেউ কেউ বন্দি হয়েছে এবং কেউ কেউ অস্ত্রত্যাগ-পূর্বক আত্মসমর্পণ করার পরও নির্যাতন ও মৃত্যু এড়াতে পারেনি। অনেক নিহত ব্যক্তি হয়তো সন্ত্রাসী ছিল না, সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী ছিল। তারাও এড়াতে পারেনি নির্যাতন ও মৃত্যু। এটা একটা বড় অভিযোগ।

এই অভিযোগগুলো ক্রমশ জনগণের মনে দানা বেঁধেছে এবং আওয়ামী লীগ সরকারও এই অভিযোগ ও সন্দেহ নাগরিক মন থেকে দূর করতে পারেননি। বরং সাবেক বিএনপি সরকারের একটি বিতর্কিত লেবাস দীর্ঘকাল বহন করে চলেছেন। এটা বোধ হয় আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বৈশিষ্ট্য, তারা ক্ষমতার বাইরে থাকলে যে সব আইন কালাকানুন আখ্যা দিয়ে বাতিল করার দাবি তোলেন, ক্ষমতায় গেলে সে সব আইন নিজেদের গদির স্বার্থে সযত্নে রক্ষা করে চলেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সরকার সন্দেহভাজন যে কোনো ব্যক্তিকে বিনা বিচারে দীর্ঘকাল আটক রাখার জন্য ‘ভারত রক্ষা আইন’ নামে একটি আইন প্রণয়ন করেছিল। যুদ্ধের পর খাস ব্রিটেনে বিশেষ নিরাপত্তা আইন উঠে যায়; কিন্তু ভারতে ভারত রক্ষা আইনটি ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামে বহাল রাখা হয়। ভারত-ভাগের পর পাকিস্তানে ‘জননিরাপত্তা আইন’ নামের কালাকানুনটি পুনঃপ্রবর্তিত হয়। এই আইন দিয়ে তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার তাদের বিরুদ্ধবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর ৩৫ হাজার নেতা-কর্মীকে পূর্ব পাকিস্তানে আটক করে রেখেছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, এই সরকার ‘স্পেশাল পাওয়ার্স অ্যাক্ট’ নামে একটি গণতন্ত্রবিরোধী আইন প্রবর্তন করেছে এবং সংসদীয় শাসন পদ্ধতি বিলোপ করেছে। যারা এই অভিযোগ তুলেছিলেন, দেখা গেল তারা ক্ষমতায় গিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইন বহাল রেখেছেন এবং সংসদীয় গণতন্ত্রে দীর্ঘকাল ফিরে যাননি।

পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নির্যাতনকারী যে ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ নামে একটি কালাকানুন প্রবর্তিত হয়েছিল, স্বাধীন বাংলাদেশ সেটি স্বাভাবিকভাবেই বিলুপ্ত হবে বলে আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু ‘অর্পিত সম্পত্তি আইন’ নামে এই আইন এখনও টিকে আছে এবং লাল ফিতার দৌরাত্ম্যমুক্ত হয়ে তা কবে কার্যকরভাবে বাতিল হবে তা বলা মুশকিল। জেনারেল এরশাদ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর অবৈধভাবে সংবিধানে যে রাষ্ট্রধর্মের বিধান ঢুকিয়েছেন, তা সেক্যুলার আওয়ামী জোটের শাসনামলেও পরম যত্নে লালিত হচ্ছে।

অপারেশন ক্লিন হার্ট নামে পরিচিত অভিযানের দায়মুক্তির আইনটি করে গেছে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। এই দৈত্যের বোঝা বহন করার দায় বা দায়িত্ব কোনোটাই আওয়ামী লীগ সরকারের ছিল না। তবু সন্ত্রাস দমনের স্বার্থে যদি যৌথ বাহিনীর এই অভিযান অব্যাহত রাখা দরকার ছিল, তাহলে ক্ষমতায় আসার সঙ্গে সঙ্গে এই দায়মুক্তির আইন, যা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং অবৈধ তা সংশোধন বা বাতিলের ব্যবস্থা করে যৌথ বাহিনীর কার্যক্রম জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিৎ ছিল। তাতে যৌথ বাহিনীর এই অভিযানের স্বচ্ছতা ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়ত।

দেশের সঙ্কটময় অবস্থায় সব দেশের সরকারই জরুরি অবস্থার কার্যক্রম গ্রহণ করেন। কিন্তু তা স্বল্প সময়ের জন্য থাকে, থেরাপির মতো। তাতে অবশ্যই নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হয়। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে স্বল্পমেয়াদী এই ব্যবস্থা জনগণ মেনে নেয়। কিন্তু কোনো দুষ্টবুদ্ধির সরকার তাদের গদি রক্ষার জন্য দীর্ঘকাল জরুরি অবস্থার কার্যক্রম দ্বারা দেশ চালাতে চায় তখনই বিপত্তি দেখা দেয়। জরুরি অবস্থার কার্যক্রমগুলো তখন অকার্যকর হয়ে পড়ে।

কোনো রোগী অ্যান্টিবায়োটিক ঔষধ দ্বারা দীর্ঘকাল চিকিৎসিত হলে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের যেমন কোনো কার্যকারিতা থাকে না, জরুরি অবস্থার অতি-ব্যবহার বা দীর্ঘকালীন ব্যবহারেও একই অবস্থা ঘটে। সত্যি বড় বিচিত্র এই বঙ্গদেশ। এই দেশেই বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান আড়াই বছরের বেশি রাতে কারফিউ জারি রেখে দেশ শাসন করে গেছেন।

যাহোক, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই যৌথ বাহিনীর ক্লিন হার্ট অপারেশনের দায়মুক্তির আইনটি হাই কোর্টের আদেশে অবৈধ হয়ে গেল। এটা এই আওয়ামী লীগ সরকারের জন্যই একটি প্লাস পয়েন্ট হবে। সরকারের উচিৎ, অতীতের সামরিক ও অসামরিক স্বৈরাচারী সরকার যে সব কালাকানুনের জঞ্জাল দেশে জমিয়ে রেখে গেছেন, সেগুলোর কলঙ্ক থেকে জাতিকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া।

দেশে কেবল গণতন্ত্র চাইলেই হয় না, গণতন্ত্রের বিধি-বিধানগুলোও আন্তরিকতার সঙ্গে মেনে চলা দরকার।

 


মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।

নিবন্ধনের জন্য আবেদিত
Desing & Developed BY MONTAKIM